আইনের শাসনের কী নিদারুণ দৃষ্টান্ত!

সম্পাদকীয়

মানব পাচার প্রতিরোধ আইনে দায়ের হওয়া মামলার ৯৫ শতাংশ কেন খারিজ হয়েছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কি তা খতিয়ে দেখবে? নাকি পরিসংখ্যান টালি করাই তাদের কাজ? নইলে নারী পাচার ও ধর্ষণের যে মামলায় ভারতে বিচার ও সাজা হলো, সেই মামলা এই দেশে তিন বছর ধরে ঝুলে থাকে কী করে? অপর এক মামলায় পাচারের শিকার নারী ভারতে জেল খাটছেন। তাঁর বাবা পাচারকারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করায় মিথ্যা মামলায় জেল খাটছেন। পাচারকারীরা খালাস। আইনের শাসনের কী নিদারুণ দৃষ্টান্ত!

প্রথম আলোর প্রতিবেদন বলছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মানব পাচারসংক্রান্ত এক প্রতিবেদন তৈরি করেছে। ওই প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, এই সময়কালে ৩৩২টি মামলা হয়েছে, এর ৩১৬টিতে আসামিরা খালাস পেয়ে গেছেন। শুধু ২০২৩ সালের প্রথম ৯ মাসে আসামিরা খালাস পেয়েছেন, এমন নয়। ২০২১-২০২২ সালে একটি মামলাতেও আসামিদের সাজা হয়নি। তাহলে বিষয়টা কি এই দাঁড়াল যে ভুক্তভোগীদের দায়ের করা এই মামলাগুলো মিথ্যা ছিল? নাকি এই তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সরকার বোঝাতে চাইছে বাংলাদেশ থেকে মানব পাচার হয় না?

তাতে কি কোনো কাজ হবে? এই তো গত বছর যুক্তরাষ্ট্র ২০২৩ সালের মানব পাচার প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশ মানব পাচার প্রতিরোধে ন্যূনতম মান পূরণ করতে পারেনি। তবে তারা চেষ্টা করছে। এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের সক্ষমতা, আইনি পদক্ষেপ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সম্পৃক্ততা আরও বাড়াতে হবে।

বাংলাদেশের আইন ও বিচারব্যবস্থা নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই। ৯৫ শতাংশ মামলা খারিজ হওয়া প্রসঙ্গে অংশীজনেরা বলেছেন, সঠিকভাবে মামলা তদন্ত না করা, মানব পাচারকারী চক্রের সঙ্গে টাকার বিনিময়ে আপস-মীমাংসার কারণে আসামিরা খালাস পেয়ে যাচ্ছেন। মুখে মুখে ও কাগজপত্রে মানব পাচার বন্ধে সরকার তার মরিয়া ভাব দেখিয়ে যাচ্ছে। মানব পাচার প্রতিরোধ আইন আছে দেশে। গত বছর জাতিসংঘের সঙ্গে জোট বেঁধে সরকার আবার ‘ন্যাশনাল স্টাডি অন ট্রাফিকিং ইন পারসনস’ প্রকাশ করেছে। সরকারের জানতে বাকি নেই কেন, কারা পাচার হয়ে যায়। পাচারকারীরাই–বা কারা। তাহলে কেন আসামিরা খালাস পায়?

এ নিয়ে বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সালমা আলী বলেছেন, মানব পাচারের মামলা পুলিশের কাছে খুবই লাভজনক মামলা। তদন্ত কর্মকর্তারা ভুক্তভোগী ও আসামি উভয় পক্ষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তদন্ত দীর্ঘদিন আটকে রাখেন। মানব পাচারকারী চক্রের সদস্যরা অত্যন্ত প্রভাবশালী। ফলে আসামিদের শাস্তি হয় না।

আইনের শাসন কার্যকর না থাকলে হাজারটা আইন করেও অপরাধ ঠেকানো যাবে না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, হরেদরে মামলা খারিজ হওয়ায় তদন্তের নির্দেশিকা দেওয়া হয়েছে। আমরা এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। তবে নির্দেশনা জারি করা সহজ, এই নির্দেশনা মাঠপর্যায়ে যেন অনুসরণ করা হয়, তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। নির্দেশনা অনুসরণ করা না হলে তদন্ত কর্মকর্তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা হোক।

মানব পাচারের মামলায় বিচার নিশ্চিত করতে একাধিক পক্ষ আছে। অভিবাসনপ্রত্যাশী, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, জনশক্তি অফিস, পুলিশ, সরকারপক্ষের উকিল ও ট্রাইব্যুনালের বিচারক। মাঠপর্যায়ে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের সচেতন করা জরুরি। তাঁদের জানানো উচিত দালালদের মাধ্যমে অবৈধভাবে বিদেশে গেলে তাঁর বাকি জীবন জেলে কাটাতে হতে পারে। সেই সঙ্গে পাচারকারীদেরও শাস্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

এ তো গেল পাচারের পর বিচার নিয়ে। সরকারি প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক সংকট, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি আছে, এমন এলাকাগুলোয় পাচারের ঘটনা বেশি ঘটছে। তা ছাড়া সরকারিভাবে বিদেশে যাওয়ার খরচ বেশি হওয়ায় মানুষ দালালদের খপ্পরে পড়ে পাচার হয়ে যাচ্ছেন। পাচারের শিকার মানুষের জন্য সরকার সুবিচার নিশ্চিত করতে পারছে না। পাচার যেন না হয়, অন্তত সেদিকে তারা নজর দিক।