নিত্য যানজটের ঢাকা শহরে শিশুশিক্ষার্থীদের নিরাপদ কোনো পরিবহন নেই। খুব কম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুশিক্ষার্থীদের নিয়ে আসার জন্য নিজস্ব পরিবহনব্যবস্থা আছে। আবার ব্যক্তিগত গাড়ি, অটোরিকশা এমনকি রিকশায় করে শিশুদের বিদ্যালয়ে নিয়ে যাবেন, সেই সামর্থ্য সবার নেই। বাধ্য হয়ে অভিভাবকদের বেশির ভাগ শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ স্কুলভ্যানে পাঠান খরচ বাঁচাতে।
স্কুলভ্যান মানে তিন চাকার একটি ভ্যানগাড়ি, যার ওপরে খাঁচার মতো কাঠামো। প্রতিটি স্কুলভ্যানে ছয় থেকে আটজন করে স্কুলে যাওয়া–আসা করে। জনপ্রতি ব্যয় দূরত্বভেদে মাসে এক থেকে তিন হাজার টাকা, যা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে স্কুলের বেতনের চেয়ে বেশি। রিকশা কিংবা অটোরিকশায় শিশুদের আসা–যাওয়া করতেও অভিভাবকদের বেশি টাকা ব্যয় হয়। এ ছাড়া ওই সব বাহনে অভিভাবকদেরও সঙ্গে যেতে হয়।
পৃথিবীর সব জনবহুল শহরেই শিশুদের স্কুলে আনা–নেওয়ার জন্য স্কুলবাস থাকে। আর যেখানে স্কুলবাস, সেখানে গণপরিবহনে তাদের যাতায়াতের ব্যবস্থা করা হয়। এসব ক্ষেত্রে যেসব অভিভাবকের ব্যক্তিগত গাড়ি আছে, তা ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করা হয় যানজট বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কায়।
প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বয়োজ্যেষ্ঠ একজন নগরবাসী বলেন, নাতিকে নিয়ে স্কুলে আসা-যাওয়া করতে দিনে রিকশাভাড়া লাগে ২০০ টাকা, মাসে ২২ দিনে ৪ হাজার ৪০০ টাকা। রিকশায় যেতেও ভয় লাগে; কিন্তু কিছু করার নেই। নাতির ক্লাসের পুরো সময় তাঁকে স্কুলের সামনে বসে থাকতে হয়। স্কুলে দিয়ে বাসায় ফিরে আবার এসে নাতিকে নিতে আরও ২০০ টাকা খরচ হবে। দিনে খরচ দাঁড়াবে ৪০০ টাকা। স্কুলের বেতন মাসে ২ হাজার ২০০ টাকা। আর যাতায়াত খরচ এর দ্বিগুণ। স্কুলবাস থাকলে তাঁর পরিবারের খরচ কমত, ভোগান্তিও কমত।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্কুলভ্যানের মতো অনুমোদনহীন যানবাহন, রিকশা, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও মোটরসাইকেল ঝুঁকিপূর্ণ। অন্যদিকে ব্যক্তিগত গাড়ি বা প্রাইভেট কার রাজধানীর যানজট বাড়াচ্ছে। সকালে ক্লাস শুরুর আগে এবং দুপুর ও বিকেলে ছুটির সময় স্কুলকেন্দ্রিক সড়কে যানজটে ব্যাপক ভোগান্তি তৈরি করে এই ব্যক্তিগত গাড়ি।
এসব বাহন কেবল ঝুঁকিপূর্ণ নয়, অনেক সময় দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাবে, দেশে গত সাড়ে পাঁচ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৫ হাজার ৩৮৪ জন নিহত হয়েছেন, যার ১৩ শতাংশই শিক্ষার্থী। সংখ্যায় তারা ৪ হাজার ৬২৮ জন। এর মধ্যে প্রায় ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়া-আসার পথে যানবাহনের চাপায় বা ধাক্কায় আর ১৬ শতাংশ শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয় বিভিন্ন যানবাহনের যাত্রী হিসেবে।
দুই কোটি মানুষের এই ঢাকা শহরে গণপরিবহনবান্ধব করা যায়নি সরকারের নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও। সমন্বিত বাস সার্ভিস চালুর কথা বলা হয়ে আসছে বহু বছর ধরে। কোনো সরকারই সেটি বাস্তবায়ন করতে পারেনি। উদ্যোগ নিলেও অল্প দিনেই তা থমকে গেছে। এখন নতুন সরকারও বিষয়টি নিয়ে ভাবছে, তারাও কিছু করার চেষ্টা করছে। এখন দেখার বিষয় কতটা কী করতে পারে। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে এবং শিক্ষার্থীদের আনা–নেওয়ায় যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিরাপদ বাহনের প্রতি জোর দিতে হবে।
আবার অত্যন্ত জনবহুল ঢাকা শহরে স্কুলবাসও একমাত্র সমাধান নয়। বিশেষজ্ঞদের মত হচ্ছে, ঢাকার মতো জনবহুল শহরে এলাকা বা কমিউনিটিভিত্তিক মানসম্পন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হওয়া জরুরি। যে এলাকার শিশু, সেই এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করবে। কিন্তু এখন দূরদূরান্ত থেকে বা বিভিন্ন এলাকা থেকে শিক্ষার্থীরা যখন একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসা–যাওয়া করে, তখন যানজটে নাকাল এ শহরে বড় একটা সময় চলে যায় তাদের। সিটি করপোরেশন ও রাজউকের সহায়তায় এলাকাবাসীও এ রকম বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে পারে। বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোকেও সেভাবে ঢেলে সাজাতে পারে।