ব্যাংক খাতকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করুন

বারবার পুনঃ তফসিলের সুযোগসহ নানা ছাড় দেওয়ার পরও খেলাপি ঋণের লাগাম টেনে ধরতে না পারাটা যারপরনাই হতাশাজনক। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হচ্ছে, রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের পাশাপাশি বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোও মন্দ ঋণের ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ব্যাংক খাতে সার্বিকভাবে খেলাপি ঋণ কমলেও ১৫টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক ও রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী ব্যাংকের।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাংক খাতে এখন মোট খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা। জুলাই-সেপ্টেম্বর এ তিন মাসে এককভাবে রাষ্ট্রমালিকানাধীন জনতা ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ কমা সার্বিকভাবে খেলাপি ঋণ কমার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। বেসরকারি খাতে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমেছে ৫৩৬ কোটি টাকা। জুন মাস শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি ১৯ টাকা। ফলে জুলাই-সেপ্টেম্বর এ তিন মাসে সামগ্রিকভাবে বেশির ভাগ রাষ্ট্রমালিকানাধীন, বেসরকারি ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোয় খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি যে ঊর্ধ্বমুখী, তা বলাই বাহুল্য।

রাষ্ট্র খাতের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ জুনে ছিল ৭৪ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা, যা কমে হয়েছে ৬৫ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকা। তবে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ৭৩ হাজার ৬৩৫ কোটি থেকে বেড়ে হয়েছে ৮১ হাজার ৫৩৭ কোটি টাকা। চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে বেসরকারি খাতের ৬টি ব্যাংকে খেলাপি ঋণ ৫৫ শতাংশ বেড়েছে। রাষ্ট্র খাতের ব্যাংকের সঙ্গে বেসরকারি খাতের ব্যাংকও যদি মন্দ ঋণের ক্ষেত্রে লাগামহীন হয়ে পড়ে, নিশ্চিতভাবেই তা ব্যাংক খাতের জন্য বড় সতর্কবার্তা। 

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে, তখন দেশে মোট খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি ৪১ লাখ টাকা। এখন তা দেড় লাখ কোটি টাকার ওপরে। গত ১৪ বছরে খেলাপি ঋণ প্রায় ৭ গুণ বেড়েছে। যদিও বিভিন্ন সময়ে সরকারের অর্থমন্ত্রীদের পক্ষ থেকে বারবার অঙ্গীকার করা হয়েছে, খেলাপি ঋণ আদায়ে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। কিন্তু সেটা কেবল মৌখিক প্রতিশ্রুতি হিসেবেই থেকে গেছে, বাস্তবে ঘটেছে উল্টোটা। বরং রাজনৈতিক আনুকূল্যে ঋণ দেওয়ার কারণে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।

অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, দেশে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া হিসাবের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে খেলাপি ঋণের হারের দিক থেকে বাংলাদেশ দ্বিতীয়। ভারতে খেলাপি ঋণের হার মোট ঋণের যেখানে ৩ দশমিক ৯ শতাংশ, বাংলাদেশে সেখানে ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। 

খেলাপি ঋণের রাশ টেনে ধরতে না পারায় ব্যাংকগুলো তারল্যসংকটে পড়ছে এবং নতুন ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা হারাচ্ছে। ফলে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি ও বিনিয়োগের ওপর তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের ক্ষেত্রে বারবার ছাড় দেওয়ার সরকারের যে নমনীয় নীতি, সেটাকেই সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করছেন ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা। উপরন্তু এ বছর জাতীয় সংসদে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করা হয়েছে। এই আইনে খেলাপিরা নতুন ঋণ নেওয়ার সুযোগ পাবেন। ফলে ঋণ পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার শঙ্কা থেকেই যায়।

খেলাপি ঋণ আদায় ও ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রচলিত নীতিমালাগুলো অনুসরণের বিকল্প নেই। দেউলিয়া আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করা প্রয়োজন। ব্যাংক খাতকে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত না করা গেলে খেলাপি ঋণের দুষ্টচক্র থেকে বের হওয়ার পথ নেই।