বাংলাদেশে সফর শেষে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাশেলেত দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যে বিবৃতি দিয়ে গেলেন, তাকে যৌক্তিক, ভারসাম্যপূর্ণ ও বাস্তবসম্মত হিসেবেই বিবেচনা করতে হবে। চার দিনের বাংলাদেশ সফরের সময় তিনি আইনমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক এবং প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন। পাশাপাশি দেশের মানবাধিকারকর্মী, গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তির স্বজন, নাগরিক সমাজ, কূটনীতিক এবং কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের সঙ্গেও মতবিনিময় করেন। এটা পরিষ্কার, সব পক্ষই জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের কাছে নিজ নিজ অবস্থান তুলে ধরতে ও ব্যাখ্যা করতে পেরেছে।
গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হওয়া, বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়নসহ নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। দেশের ও বৈশ্বিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো এ নিয়ে ধারাবাহিকভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করে এলেও সরকার বরাবরই এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাশেলেতের এই সফর বাস্তব পরিস্থিতির মূল্যায়ন ও পর্যবেক্ষণের একটি সুযোগ করে দিয়েছে।
মিশেল ব্যাশেলেত সফরের শেষ পর্যায়ে সংবাদ সম্মেলনে যে বিবৃতিটি দিয়েছেন, তা বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে আমরা মনে করি। তিনি মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ থাকলে তা অস্বীকার না করে সরকারকে আমলে নিতে বলেছেন। গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং নির্যাতনের গুরুতর অভিযোগের বিষয়ে তিনি সরকারের কাছে তাঁর গভীর উদ্বেগের কথা বলেছেন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগগুলো সুরাহার স্বার্থে স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্ত সংস্থা গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন।
মিশেল ব্যাশেলেতের বিবৃতি থেকে আমরা বুঝতে পারি যে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে তিনি কী ধারণা পেয়েছেন এবং তাঁর পর্যবেক্ষণটি আসলে কী। জাতিসংঘের কোনো সদস্যদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ দীর্ঘদিন উপেক্ষিত থাকলে সাধারণত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্তের বিষয়টি সামনে চলে আসে। সেই বিবেচনায় মিশেলের বক্তব্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান ও কর্মীদের দীর্ঘদিনের অভিযোগ ও দাবির স্বীকৃতি পাওয়া যায়।
একইভাবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কীভাবে দেশের সংবাদমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন করছে, সেলফ সেন্সরশিপের পরিস্থিতি তৈরি করেছে, তা নিয়ে আমরা অব্যাহতভাবে উদ্বেগ প্রকাশ এবং এই আইন বাতিলের দাবি করে আসছিলাম। মিশেলের বক্তব্যে এই আইন কীভাবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম সীমিত করছে, তার উল্লেখ রয়েছে।
নির্বাচন অনুষ্ঠানে এক বছরের বেশি সময় রয়েছে, কিন্তু দেশের রাজনীতিতে নির্বাচন নিয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছে। মিশেল ব্যাশেলেতের বিবৃতিতে সেই প্রসঙ্গে কিছু পরামর্শও রয়েছে। তিনি নির্বাচন সামনে রেখে নাগরিক ও রাজনৈতিক চর্চার পরিধি বাড়ানো এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, রাজনৈতিক কর্মী, মানবাধিকারকর্মী ও বিরোধী দলের শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশের ওপর জোর দিয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যাতে মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগ না করে বিক্ষোভ দমন করতে পারে, এ জন্য তাদের প্রশিক্ষণের বিষয়টি নিশ্চিত করা জরুরি বলেও মত দিয়েছেন।
আগামী মাসে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের সভায় বক্তব্য দেবেন হাইকমিশনার মিশেল ব্যাশেলেত। এই সফর থেকে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি যে ধারণা পেয়েছেন, তাঁর বক্তব্যে এর প্রতিফলন থাকবে। বাংলাদেশে সফরের শেষে তিনি যে বক্তব্য দিয়ে গেলেন, সেটিকে তাই উপেক্ষা করার সুযোগ নেই।
আমরা আশা করব, সরকার মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রশ্নে অস্বীকারের সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসবে। আমরা মনে করি, জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনারের সফর মানবাধিকার লঙ্ঘনসংক্রান্ত সব অভিযোগের বিষয়ে স্বচ্ছতা সৃষ্টির একটি সুযোগ তৈরি করেছে। সরকার এই সুযোগ গ্রহণ করবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।