৫ আগস্ট ক্ষমতার পালাবদলের পর অন্যান্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধির সঙ্গে অনেক ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধেও মামলা দেওয়া হয়েছে। এ কারণে তাঁরা কেবল নিজ নিজ কর্মস্থলে অনুপস্থিত নন, গ্রেপ্তার এড়াতে পালিয়েও বেড়াচ্ছেন।
ইউপি চেয়ারম্যানরা বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতা বিতরণের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকেন। ওয়ারিশ সনদ, চারিত্রিক সনদ, জন্ম–মৃত্যু নিবন্ধনের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো ইউনিয়ন পরিষদ থেকে হয়ে থাকে। স্থানীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডেও তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের বরাতে প্রথম আলোর খবরে বলা হয়, ৫ আগস্টের পর থেকে সারা দেশে ১ হাজার ৪১৬ জন ইউপি চেয়ারম্যান কার্যালয়ে অনুপস্থিত, যা মোট ইউপির এক-তৃতীয়াংশ। তাঁদের বেশির ভাগের নামে হত্যা মামলা হয়েছে। অনেকে গ্রেপ্তারের আতঙ্কে আছেন। আবার কেউ কেউ হামলা হওয়ার আশঙ্কায় কার্যালয়ে যাচ্ছেন না।
কেন এই অবস্থা তৈরি হলো? যেসব ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে মামলা (বেশির ভাগই হত্যা মামলা), তাঁদের পক্ষে কি যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ আছে? বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন হয়েছে মূলত শহরাঞ্চলে, যা সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার মধ্যে। প্রথম আলোর খবর থেকেই জানা যায়, এসব মামলার বেশির ভাগই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও ব্যক্তিগত রেষারেষির কারণে।
সংকট উত্তরণে সরকার সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নে সরকারি কর্মকর্তাদের খণ্ডকালীন নিয়োগ দিয়েছে। কিন্তু সেটা খুব কার্যকর হয়নি। প্রথম আলো বেশ কয়েকটি ইউনিয়নে গিয়ে কার্যালয়ে তাঁদের কাউকে পায়নি। এ অবস্থায় সেবাপ্রার্থীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার দেখা পাননি। প্রথম আলোর আরেক খবরে বলা হয়, গরিব মানুষের ভাতা দেওয়ার কাজও বন্ধ আছে ইউপি চেয়ারম্যানদের অনুপস্থিতিতে।
বর্তমান সরকার ইতিমধ্যে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদের জনপ্রতিনিধিদের বরখাস্ত করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যদেরও বাদ দেওয়ার চিন্তাভাবনা চলছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
কিন্তু এই সিদ্ধান্তের ফল কী হবে, সেটাও ভেবে দেখার বিষয়। স্থানীয় সরকারবিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া ঠিক হবে না জানিয়ে বলেন, যেসব ইউপি চেয়ারম্যান অনুপস্থিত, সরকারের উচিত হবে প্রথমে তাঁদের নোটিশ দেওয়া। একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তাঁদের পরিষদে উপস্থিত হওয়ার সময় বেঁধে দেওয়া। এ সময়ে না এলে আসন শূন্য ঘোষণা করা। তারপর সদস্যদের মধ্য থেকে একজনকে চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। বাংলাদেশ ইউনিয়ন পরিষদ অ্যাসোসিয়েশন বলছে, ইউপি ভেঙে দিলে কিংবা চেয়ারম্যানদের অপসারণ করলে প্রান্তিক পর্যায়ে সরকারি সেবা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে।
যখন সর্বমহল থেকে স্থানীয় সরকার সংস্থাকে শক্তিশালী করার দাবি উঠেছে, তখন অন্তর্বর্তী সরকার দেশকে ‘স্থানীয় সরকারশূন্য’ করে ফেলেছে। এ কথা সত্য যে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোকে চরমভাবে দলীয়করণ করেছিল। বিরোধী মতের বা দলের প্রতিনিধিরা যাতে নির্বাচিত হতে না পারেন, সে জন্য নানা অপকৌশলের আশ্রয় নিয়েছিল, নির্বাচন হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাদের ইচ্ছাপূরণের হাতিয়ার।
কিন্তু মাথাব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলা কোনো সমাধান নয়। আমরা আশা করব, বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় বাস্তবানুগ সিদ্ধান্ত নেবে। সেবাপ্রার্থী জনগণকে বঞ্চিত করার অধিকার কারও নেই।