উচ্চমাত্রার দুর্নীতি কমাতে সরকারি চাকরিজীবীদের কাছ থেকে প্রতিবছর সম্পদের হিসাব নেওয়া এবং তা নিয়মিত হালনাগাদ করতে সরকারকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) যে পরামর্শ দিয়েছে, তার কার্যকারিতা সম্পর্কে পুরোপুরি সন্দেহমুক্ত হওয়া যাচ্ছে না।
বাংলাদেশের দুর্নীতি কমাতে আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক কিংবা অন্য কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থার পরামর্শ দেওয়া সরকারের জন্য মোটেই সুখকর বিষয় নয়। সরকার নিজে থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত ও কার্যকর পদক্ষেপ নিলে এ ধরনের পরামর্শ দেওয়ার প্রয়োজন হতো না।
উল্লেখ্য, সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদের হিসাব নেওয়ার বিষয়টি তো ১৯৭৯ সালে প্রণীত সরকারি কর্মচারী আইনেই আছে। আইনের বিধি ১২ ও ১৩ অনুসারে সরকারি কর্মচারীর স্থাবর সম্পত্তি অর্জন, বিক্রি ও সম্পদ বিবরণী জমার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এমনকি এতে জমি-বাড়ি-ফ্ল্যাটসহ যেকোনো সম্পদ কিনতে বা বিক্রি করতেও সরকারের অনুমতি নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সম্পদ কেনার ক্ষেত্রে তাঁদের টাকার উৎস এবং সম্পদ বিক্রির ক্ষেত্রে দাম জানানোর কথা।
কিন্তু ‘কাজির গরু কিতাবে আছে, গোয়ালে নেই’। দেশে বর্তমানে যে ১৫ লাখ সরকারি কর্মচারী আছেন, তাঁদের সামান্য অংশই সম্পদের হিসাব দিয়ে থাকেন। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সম্পদের হিসাব দেওয়ার ব্যাপারে কড়াকড়ি করায় অনেকেই হিসাব দিয়েছিলেন।
যদিও দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতা ঘোষণাকারী আওয়ামী লীগ সরকার একটানা সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকলেও সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব নেয়নি। নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী জনপ্রতিনিধিদের সম্পদের হিসাব জনসমক্ষে প্রকাশেরও প্রয়োজন তারা বোধ করেনি। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে নীতিনির্ধারকেরা বরাবর সুকৌশলে এড়িয়ে গেছেন। এমনকি সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেওয়ার বিধান যুক্ত করায় সরকারি কর্মকর্তারা আরও আশকারা পেয়েছেন।
এ কারণেই আমরা বেসিক ব্যাংক-কাণ্ড, হল-মার্ক কাণ্ড, বালিশ ও পর্দা-কাণ্ডের পর জনপ্রশাসনে বেনজীর, মতিউরদের আবির্ভাব ঘটতে দেখি। মূলধারার সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেসব তথ্য-উপাত্ত বেরিয়ে এসেছে, তাতে আরও অনেক ছোট–বড় সাবেক ও বর্তমান আমলার নাম এসেছে।
পত্রিকান্তরের খবর থেকে জানা যায়, বর্তমানে দুদকের অনুসন্ধানে রয়েছে ২ হাজার ২১৫টি ফাইল। এগুলোর মধ্যে অর্ধশত আমলা এবং সাবেক ও বর্তমান মিলে অন্তত ২০ পুলিশ কর্মকর্তার ফাইল দীর্ঘদিন ধরে আটকে আছে। বড় কোনো অঘটন ঘটলে দুদককে কিছুটা নড়েচড়ে বসতে দেখি। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে আবার সবকিছু আগের মতো চলতে থাকে। মতিউর রহমানদের মতো দাগি দুর্নীতিবাজেরা দুদক থেকে চারবার ‘নিষ্কলুষ’ সনদ পেয়েছেন।
চলতি জাতীয় সংসদ অধিবেশনে সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংসদ সদস্যদের হম্বিতম্বি দেখে মনে হয়, এত দিন তাঁরা কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলেন। হঠাৎ জেগে দেখেন, সরকারি কর্মকর্তারা দেশের ‘সর্বনাশ’ করে ফেলেছেন।
দেশে ন্যূনতম আইনের শাসন থাকলে প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এভাবে দুর্নীতি প্রসারিত হতে পারত না। অভিযোগ আছে, আমলাদের দুর্নীতির প্রসার ঘটার পেছনে রাজনীতিকদেরও ভূমিকা আছে। সরকার মুখে দুর্নীতির বিরুদ্ধে যতই শূন্য সহিষ্ণুতার কথা বলুক, তাদের কর্মকাণ্ডে এর কোনো প্রতিফলন নেই।
এত দিন সংবাদমাধ্যমসহ নানা মহল থেকে সরকারকে দুর্নীতির বিষয়ে সতর্ক করলেও নীতিনির্ধারকেরা আমলে নেননি। আইএমএফের পরামর্শে হলেও যদি তাঁদের চৈতন্যোদয় হয়, দেশটা অন্তত রক্ষা পাবে। অন্যথায় মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, ‘চাটাদের’ দখলেই চলে যাবে।