জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে ভাষণে

সম্পাদকীয়

৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়ার পর দেশবাসীর উদ্দেশে দেওয়া দ্বিতীয় ভাষণে ড. মুহাম্মদ ইউনূস গণ-অভ্যুত্থান–পরবর্তী আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, দাবি আদায়ে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মাঠে নামা, শিল্প খাতে শ্রমিক অসন্তোষ ও অর্থনৈতিক সংকটের ওপর যেমন আলোকপাত করেছেন, তেমনি পরিস্থিতি উন্নয়নে গত এক মাসে নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগ এবং ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ বিনির্মাণে একটি রূপকল্প তুলে ধরেছেন। এই ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা আইন নিজের হাতে তুলে না নেওয়া, অর্থনীতির চাকা সচল রাখা ও মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানো ও ঋণ পরিশোধের ওপর জোর দিয়েছেন। এর প্রতিটি ক্ষেত্রে আইনানুগ ও বাস্তববাদী পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেছেন।

শ্রমিক অসন্তোষের কারণে শিল্পকারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ‘শ্রমিক ভাইবোনদের অনেক দুঃখ আছে। কিন্তু সেটা প্রকাশ করতে গিয়ে মূল জীবিকাই বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে সেটা ঠিক হবে না। মালিক-শ্রমিক উভয় পক্ষের সঙ্গে আলাপ করে এসব সমস্যার সমাধান অবশ্যই বের করা হবে।’ আমরা আশা করব, অবিলম্বে শিল্পাঞ্চলে শান্তি ফিরে আসবে এবং উৎপাদন ব্যাহত হয়, এমন কোনো কাজ কোনো পক্ষ করবে না।

প্রধান উপদেষ্টা খোলামনে সমালোচনা করার জন্য সংবাদমাধ্যমের প্রতি যে আহ্বান জানিয়েছেন, তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এর আগে যাঁরাই ক্ষমতায় এসেছেন, সংবাদমাধ্যমকে নানাভাবে ভয়ভীতি দেখিয়েছেন। সমালোচনার কারণে সংবাদমাধ্যম বন্ধ করা, সাংবাদিক ও সম্পাদকদের বিরুদ্ধে মামলা করার ঘটনাও কম ছিল না। তিনি সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার পরিপন্থী বিভিন্ন আইন বাতিল বা প্রয়োজনে সংশোধনের আশ্বাস দিয়েছেন। আমরা মনে করি, সংবাদমাধ্যমের কাজই হলো ক্ষমতাকে প্রশ্ন করা। সেই প্রশ্ন যত বেশি তীক্ষ্ণ ও তীব্র হবে, সুশাসনের পথ তত প্রশস্ত হবে।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিভিন্ন মহল থেকে রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি উচ্চারিত হয়েছে। কিন্তু সেই সংস্কার কীভাবে হবে, কারা করবেন ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্ন ছিল। প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ভাষণে সংস্কারের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে ছয়টি কমিশন গঠনের কথা বলেছেন। কমিশনগুলোর প্রধান হিসেবে যাঁদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে, তাঁরা হলেন যথাক্রমে আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী (জনপ্রশাসন সংস্কার), বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমান (বিচার বিভাগ সংস্কার), বদিউল আলম মজুমদার (নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার), শাহদীন মালিক (সংবিধান সংস্কার), সফর রাজ হোসেন (পুলিশ প্রশাসন সংস্কার) এবং ইফতেখারুজ্জামান (দুর্নীতি দমন সংস্কার)। তাঁরা সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ ও দক্ষ।

এসব কমিশন ১ অক্টোবর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করতে পারবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেছেন, পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে কমিশন প্রতিবেদন দেবে এবং এর ভিত্তিতে সরকার পরবর্তী পর্যায়ে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পরামর্শ সভার আয়োজন করবে। সংস্কার ভাবনার রূপরেখা চূড়ান্ত করার আগে ছাত্রসমাজ, নাগরিক সমাজ, রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি ও সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ব্যাপকভিত্তিক পরামর্শ করা হবে বলেও প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ভাষণে উল্লেখ করেছেন।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর ভাষণে নির্বাচনের নামে সংখ্যাগরিষ্ঠতার একাধিপত্য ও দুঃশাসন মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার অশুভ তৎপরতা থেকে দেশকে মুক্ত করার যে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, তাতে সর্বস্তরের মানুষের মনের কথাই প্রতিধ্বনিত হয়েছে। ভবিষ্যতে ভোটের মাধ্যমে যাঁরাই ক্ষমতায় আসুন না কেন, তঁারা বিষয়টি মনে রাখবেন আশা করি। নির্বাচনে জয়ী হওয়া মানে স্বেচ্ছাচারিতার অবাধ ছাড়পত্র নয়।

প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ভাষণে গত এক মাসে সরকারের কর্মকাণ্ডের নানা দিক যেভাবে তুলে ধরেছেন, তাতে একধরনের জবাবদিহির প্রতিফলন রয়েছে। একই সঙ্গে তাঁর ভাষণ জনমনে আশাবাদ তৈরি ও একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার আকাঙ্ক্ষাকে জোরদার করেছে।