হঠাৎ মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্তে তৈরি পোশাক, রেস্তোরাঁ, মিষ্টিসহ বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। তাঁরা বলছেন, কোনো আলোচনা না করে ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্তটি অবিবেচনাপ্রসূত। এতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমবে। নতুন করে সংকটে পড়বে ব্যবসা-বাণিজ্য।
মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক (সংশোধনী) অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর খসড়া সংসদবিষয়ক বিভাগের ভেটিং সাপেক্ষে গত বুধবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়। দুই বছরের বেশি সময় ধরে যেখানে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে, সেখানে এই সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ২০২৩ সালে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) পর্যবেক্ষণে জানা যায়, দেশের ৬৮ শতাংশ মানুষ আয়কর দেন না। জয়েন্ট স্টক কোম্পানিতে ২ লাখ ১৩ হাজার কোম্পানি নিবন্ধিত হলেও আয়কর দেয় মাত্র ৪৫ হাজার। বিভিন্ন খাতে কর ফাঁকির কারণে সরকার হাজার হাজার কোটি টাকার আয়কর থেকে বঞ্চিত।
অন্তর্বর্তী সরকার করের আওতা না বাড়িয়ে কিংবা কর ফাঁকি রোধ করার ব্যবস্থা না করে সরল রাস্তার সমাধান হিসেবে ভ্যাট বাড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। এতে নিশ্চিত করেই সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ওপর চাপ আরও বাড়বে। সরকারের এই সিদ্ধান্তের কারণে তৈরি পোশাক, এসি রেস্তোরাঁ, মিষ্টি, নন-এসি হোটেলসহ ৪৩ ধরনের পণ্য ও সেবায় ভ্যাট বেড়ে ১৫ শতাংশ হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে বলেছেন, ‘ভ্যাট বাড়লেও জিনিসপত্রের দামের ওপর তেমন প্রভাব পড়বে না। অত্যাবশ্যকীয় সব পণ্যের শুল্ক কমিয়ে জিরো (শূন্য) করে দেওয়া হয়েছে।’ বাস্তবতা হলো যেসব পণ্যের ওপর কর কমানো বা শূন্য করা হয়েছে, সেসব পণ্যের দামও তো তেমন কমেনি।
পৃথিবীর সব দেশেই রাজস্ব আদায়ের প্রধান খাত হলো প্রত্যক্ষ কর। যে যত বড় ধনী, তাকে তত বেশি আয়কর দিতে হয়। কিন্তু আমাদের দেশে করের আওতা না বাড়িয়ে ভ্যাটকে রাজস্ব আয়ের প্রধান হাতিয়ার করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রেও বৈষম্য আছে। বর্তমানে ভ্যাট নিবন্ধন নেওয়া প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৫ লাখ ২৫ হাজার। এর মধ্যে গড়ে সাড়ে তিন লাখ প্রতিষ্ঠান নিয়মিত ভ্যাট দিয়ে থাকে। এর বাইরে যে লাখ লাখ প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেসব প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাটের আওতায় আনতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না।
সম্প্রতি ঋণের শর্ত হিসেবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সব ক্ষেত্রে ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ করার শর্ত দিয়েছে। জনজীবনের কথা চিন্তা না করে যদি শুধু আইএমএফের শর্ত পূরণের জন্য ভ্যাট বাড়ানো হয়ে থাকে, সেটা হবে দুর্ভাগ্যজনক। অর্থনীতিবিদদের মতে, প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর মাধ্যমে রাজস্ব আদায় বাড়ানো গেলে সবচেয়ে ভালো হয়। সরকারের উচিত ধনীদের ওপর আরও বেশি কর আরোপ করে ঘাটতি পুষিয়ে নেওয়া। এমনকি কর ব্যবস্থাপনায় যেসব ত্রুটি ও দুর্বলতা আছে, সেগুলো দূর করলেও রাজস্ব অনেক বাড়বে।
আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হলো সরকার প্রশাসনকে উল্টো পিরামিড বানিয়ে যেভাবে ব্যয় বাড়িয়ে চলেছে, তা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। বিগত সরকার সরকারি কর্মকর্তাদের খুশি করতে অনেক অনৈতিকভাবে সুবিধা দিয়েছে। তারা সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য দেড় কোটি টাকার গাড়ি কিনেছে, গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মাসে ৫০ হাজার টাকা করে ভাতা দিয়েছে।
পূর্ববর্তী সরকার যখন এসব অনৈতিক সুবিধা দিয়েছিল, তখন বর্তমান সরকারের নীতিনির্ধারক পদে যাঁরা আছেন, তাঁদের অনেকে কঠোর সমালোচনা করেছেন। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে এখন তাঁরা সেই নীতিই অনুসরণ করে চলেছেন। প্রশাসনের ব্যয় কমিয়ে ও অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাদ দিয়ে সরকার ঘাটতি মেটাতে পারে। ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনা করা হোক।