সরকারি দলের নেতারা হামেশা বলে বেড়াচ্ছেন, নির্বাচন কমিশন (ইসি) স্বাধীন ও সার্বভৌম। নির্বাচনের বিষয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার ও ক্ষমতা কমিশনের আছে।
তাঁদের এসব বক্তব্যের সঙ্গে সরকারের কাজের মিল খুব কমই দৃশ্যমান। গত সোমবার জাতীয় সংসদে উত্থাপিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) সংশোধনী প্রস্তাবটি নিয়ে ইতিমধ্যে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে। আপত্তি জানিয়েছেন বিরোধী দলের সংসদ সদস্য ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯১ (এ) ধারায় বলা আছে, নির্বাচন কমিশন যদি এই মর্মে সন্তুষ্ট হয় যে নির্বাচনে বলপ্রয়োগ, ভীতি প্রদর্শন, চাপ সৃষ্টিসহ বিভিন্ন বিরাজমান অপকর্মের কারণে যুক্তিযুক্ত, ন্যায়সংগত এবং আইনানুগভাবে নির্বাচন পরিচালনা নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে না, তাহলে যেকোনো ভোটকেন্দ্র বা ক্ষেত্রমতো সম্পূর্ণ নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচনের যেকোনো পর্যায়ে ভোট গ্রহণসহ নির্বাচনী কার্যক্রম বন্ধ করতে পারবে।
সংশোধনীতে আরপিওর ৯১ ধারার (এ) উপধারায় নির্বাচন বা ‘ইলেকশন’ শব্দের বদলে ‘পোলিং’ শব্দ প্রতিস্থাপন করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ইসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ‘ইলেকশন’ শব্দ দিয়ে পুরো নির্বাচনপ্রক্রিয়া বোঝায়। অর্থাৎ তফসিল ঘোষণা থেকে শুরু করে ফলাফল ঘোষণা পর্যন্ত সময়টা হলো ‘ইলেকশন’। আর ‘পোলিং’ হলো শুধু ভোটের দিন।
এই সংশোধনী পাস হলে ইসি অনিয়মের কারণে শুধু ভোটের দিন কোনো ভোটকেন্দ্র বা পুরো সংসদীয় আসনের ভোট বন্ধ করতে পারবে। কিন্তু ‘ইলেকশন’ শব্দটি থাকলে ভোটের আগেও পরিস্থিতি বিবেচনা করে ইসি ভোট বন্ধ করতে পারত। তাই এখানে তাদের ক্ষমতা খর্ব হচ্ছে। আরপিওর সংশোধনীতে আরও বলা হয়েছে, রিটার্নিং কর্মকর্তা ফলাফল ঘোষণা করে ফেলার পর কোনো আসনের পুরো ফলাফল স্থগিত বা বাতিল করতে পারবে না ইসি। যেসব ভোটকেন্দ্রে অনিয়মের অভিযোগ আসবে, শুধু সেসব (এক বা একাধিক) কেন্দ্রের ফলাফল স্থগিত করতে পারবে। এরপর তদন্ত সাপেক্ষে ওই সব কেন্দ্রের ফলাফল বাতিল করে, সেসব কেন্দ্রে নতুন নির্বাচন দিতে পারবে ইসি।
আইনমন্ত্রী আরপিও সংশোধনীর পক্ষে যেই যুক্তিই দেখান না কেন, এর উদ্দেশ্য ও বিধেয় বুঝতে কারও অসুবিধা হয় না। স্বাধীনতার ৫২ বছর পর এসে আরপিও পরিবর্তনের প্রয়োজন হলো কেন? সংবিধান কিংবা আইনে যা–ই থাকুক না কেন, আমাদের বেশির ভাগ ইসি কর্তাভজা নীতি অনুসরণ করে আসছে। তবে এর ব্যতিক্রমও আছে। অনেকেই মনে করেন, গত অক্টোবরে গাইবান্ধা উপনির্বাচন স্থগিত করার ঘটনা সরকারের নীতিনির্ধারকদের কপালে ভাঁজ ফেলেছে। ইসির পদাধিকারীরা সিসিটিভি ক্যামেরায় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে বেশির ভাগ কেন্দ্রে অনিয়ম ও কারচুপির ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন এবং পুরো নির্বাচনটি স্থগিত ঘোষণা করেন। বাংলাদেশে এটা ছিল ব্যতিক্রমী ঘটনা।
নির্বাচন কমিশন এমনিতেই অসহায়। কাগজপত্রে তাদের যত ক্ষমতাই দেওয়া হোক না কেন, তা বাস্তবায়ন করার লোকবল কিংবা অবকাঠামো নেই। এসব ক্ষেত্রে সরকারের মুখাপেক্ষী হতে হয় তাদের। এই সংশোধনী কার্যকর হলে কমিশনের ক্ষমতা আরও কমে যাবে, যা কখনোই কাম্য হতে পারে না।
আগামী বছর জানুয়ারি মাসে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। কোন সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে, সেটা নিয়ে রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিভক্ত। এই প্রেক্ষাপটে এ ধরনের সংশোধনী দেশবাসীকে কেবল ভুল বার্তা দেবে না, নির্বাচনের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা আরও বাড়াবে। এ কারণে আরপিও সংশোধনের প্রস্তাবটি প্রত্যাহার করে ইসির ক্ষমতা খর্ব করা থেকে সরকারের বিরত থাকাই বিধেয় হবে।