সংকটের সমাধান রাজনৈতিক পথেই হতে হবে 

সম্পাদকীয়

গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পর সপ্তাহজুড়ে যে সংঘাতময় পরিস্থিতির সাক্ষী হলো দেশ, সেটা কারও কাছেই কাম্য ছিল না। ওই দিনের সংঘাত, রোববারের হরতালের পর একদিন বিরতি দিয়ে মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতিবার—তিন দিনের অবরোধে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ঘটা সহিংসতায় একজন পুলিশ সদস্যসহ প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত নয়জন, যা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। যাত্রীবাহী বাস, পণ্যবাহী ট্রাকসহ শতাধিক যানবাহনে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করা হয়েছে। পুলিশ, সাংবাদিক, রাজনৈতিক কর্মী, পথচারীসহ আহত হয়েছেন কয়েক শ মানুষ।

বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়ার পাশাপাশি তাঁদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে রাজনীতিতে যে অনিশ্চয়তা ও অচলাবস্থা তৈরি হলো, তার গভীর প্রভাব নিশ্চিতভাবেই গিয়ে পড়বে মহামারি, যুদ্ধসহ নানা চাপে পড়া আমাদের নাজুক অর্থনীতিতে।

প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, ২৮ অক্টোবরের সহিংসতায় বিএনপির সমাবেশ পণ্ড হয়ে যায়। নিহত হন দুজন। আগুন দেওয়া হয় ৫৫টি গাড়িতে। রোববারের হরতালে ঢাকা ও লালমনিরহাটে দুজন নিহত হন। অন্তত ২০ জেলায় সহিংসতার ঘটনা ঘটে। নয়টি গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। একটি বাসে আগুন দেওয়া হলে বাসের সহকারী অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান। অবরোধের প্রথম দিন মঙ্গলবার দেশের ৯ জায়গায় অবরোধকারীদের সঙ্গে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষ হয়। ওই দিনের সংঘর্ষে কিশোরগঞ্জে তিনজন ও সিলেটে একজন নিহত হন। চারটি বাস ও কাভার্ড ভ্যানে আগুন দেওয়া হয়।

অবরোধের দ্বিতীয় দিন বুধবার বগুড়া ও নারায়ণগঞ্জে পুলিশের সঙ্গে অবরোধকারীদের সংঘর্ষে ১৫ জন আহত হন। বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেন লক্ষ্য করে ঈশ্বরদী বাইপাস স্টেশনের কাছে ককটেল ও পেট্রলবোমা ছোড়ে। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ কয়েকটি জায়গায় যাত্রীবাহী বাসে আগুন দেওয়া হয়। পণ্যবাহী ট্রাকেও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। অবরোধের শেষ দিনেও ঢাকায় বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে।

সপ্তাহজুড়ে সংঘাতের রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগের মধ্যে পড়েন সাধারণ মানুষ। দূরপাল্লার বাস প্রায় বন্ধ থাকায় সড়কপথে ঢাকা কার্যত সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ট্রেন ও লঞ্চ চললেও যাত্রী ছিল কম। ঢাকা, চট্টগ্রামের কিছু গণপরিবহন চললেও স্বাভাবিক দিনের তুলনায় তা ছিল অনেক কম। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কনটেইনার খালাস হয়েছে কম। অনেকে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখেন। ফুটপাতেও অনেক দোকানি তাঁদের পসরা নিয়ে বসতে পারেননি। স্কুল, কলেজ খোলা থাকলেও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ছিল কম। এসব কর্মসূচিতে স্বাভাবিক জনজীবন ব্যাহত হয়েছে, তা বলাই বাহুল্য। তিন দিনের অবরোধ কর্মসূচি শেষ না হতেই আগামী রবি ও সোমবার বিএনপি, গণতন্ত্র মঞ্চসহ কয়েকটি দল সারা দেশে অবরোধ কর্মসূচি দিয়েছে।

২৮ অক্টোবরের সংঘাতে ২৮টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় বেশির ভাগ আসামি বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতারা। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নেতাদের বাসায় বাসায় অভিযান চালানো হয়েছে। এ ছাড়া হরতাল-অবরোধের সময় সংঘটিত সহিংসতায় বেশ কয়েকটি মামলা হয়েছে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে শত শত নেতা-কর্মীকে। পুলিশ হত্যা এবং অন্যান্য সহিংসতার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে। কিন্তু আমরা মনে করি, বিএনপির শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার রাজনৈতিক অচলাবস্থাকে আরও সংকটময় করে তুলবে।

বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের মূলে রয়েছে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের দুটি অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন। নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচি, আলাপ-আলোচনাই রাজনৈতিক সংকট সমাধানের একমাত্র অবিকল্প পথ। রাস্তায় শক্তি প্রদর্শন কিংবা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার—কোনোটাই গণতান্ত্রিক রাজনীতির ভাষা হতে পারে না। হরতাল, অবরোধ, সহিংসতা, মামলা, গ্রেপ্তারের বাইরে গিয়ে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সংকটের সমাধান করতে হবে। রাজনৈতিক সংকটের সমাধান রাজনৈতিক পথেই হতে হবে। সাধারণ মানুষকে কেন মূল্য দিতে হবে?