৮ মার্চ বেশ ঢাকঢোল পিটিয়ে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হলো, যার প্রতিপাদ্য ছিল ‘নারীর সম–অধিকার, সমসুযোগ, এগিয়ে নিতে হোক বিনিয়োগ’। কিন্তু নারীর সম–অধিকার ও সমসুযোগ নিশ্চিত করতে হলে প্রথমেই যে বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন, তা হলো অর্থনৈতিক কাজে তার অংশগ্রহণ বাড়ানো। কিন্তু বাস্তবতা অনেকটা ভিন্ন।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে পুরুষের তিন ভাগের এক ভাগ আইনি অধিকার ভোগ করেন নারী। যদিও সংবিধানে বলা আছে, নাগরিক হিসেবে কারও প্রতি বৈষম্য করা যাবে না। নারীর ক্ষমতায়নের সূচকে উন্নত দেশের তুলনায় তো বটেই, দক্ষিণ এশিয়ায়ও বাংলাদেশের অবস্থান নিচের দিকে।
তৃণমূল পর্যায়ের নারীর আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে দৃশ্যত সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো (এমএফআই)। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে নারী যে ঋণ নিচ্ছেন, সেটা তাঁরা স্বাধীনভাবে ব্যবহার করতে পারেন না।
‘বাংলাদেশে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে জেন্ডারবৈষম্য’ শীর্ষক এক গবেষণায় দেখা যায়, ঋণগ্রহীতা নারীদের ৬৬ দশমিক ৩১ শতাংশ জানিয়েছেন, তাঁদের নেওয়া ঋণ স্বামী বা পরিবারের অন্য পুরুষ সদস্যরা ব্যবহার করেন। প্রায় ২৯ শতাংশ নারী ওই ঋণের টাকা নিজেরা কাজে লাগান। বাকি গ্রহীতাদের ঋণের অর্থ পরিবারের অন্য নারী সদস্যরা ব্যবহার করেন।
মোট ৫৬টি জেলার ৩ হাজার ৩০০ পরিবারের ৭ হাজার ৫৯১ নারী-পুরুষের মতামতের ভিত্তিতে গবেষণাটি করা হয়। মতামত প্রদানকারীদের মধ্যে সাড়ে ৫৮ শতাংশ বা ৪ হাজার ৪৪২ জন ছিলেন নারী। গবেষণার ফলাফলে বলা হয়, ব্যাংক, মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সেবা (এমএফএস) এবং ক্ষুদ্রঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠান—এই তিন ধরনের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নারীর আর্থিক অন্তর্ভুক্তি হয়। ব্যাংক ও এমএফএস—এই দুই ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে নারীরা বেশ পিছিয়ে আছেন। তবে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে নারীরা পুরুষদের তুলনায় এগিয়ে আছেন। এখানে জেন্ডার গ্যাপ নারীর পক্ষে, ৫৬ শতাংশের বেশি।
দেশে ক্ষুদ্রঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাকসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। এসব ঋণ যাঁদের দেওয়া হয়, তাঁদের ৯০ শতাংশ নারী। কিন্তু সব ঋণগ্রহীতা যদি সেটা স্বাধীনভাবে ব্যবহার করতে না পারেন, তাহলে ক্ষমতায়ন হবে কী করে? কতজন নারী ঋণ নিলেন, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সেই ঋণ তাঁরা ব্যবহার করতে পারলেন কি না।
অনেক ক্ষেত্রে নারী ঋণ নিলেও সেটি কি তঁারা কাজে লাগাতে পারেন না। এ ক্ষেত্রে পরিবারিক ও সামাজিক বাধার মুখে পড়তে হয় তাঁদের। নারী কোন কাজ করবেন, কোন কাজ করবেন না, এই নির্দেশনা দিয়ে থাকেন পুরুষ। শত বছর আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নারীর ক্ষমতায়ন সম্পর্কে লিখেছিলেন, নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার/ কেন নাহি দিবে অধিকার/ হে বিধাতা?
আমাদেরও প্রশ্ন যে দেশে নারী প্রধানমন্ত্রী এবং জাতীয় সংসদের স্পিকার হতে পারেন, সে দেশে কেন তঁাকে ঋণ ব্যবহারের বিষয়ে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার দেওয়া হবে না। নারী যে আপন ভাগ্য গড়ে তুলতে সক্ষম, সেটা অনেক আগেই প্রমাণিত হয়েছে। নারী তাঁর কাজের বিষয়ে নিজেই সিদ্ধান্ত নেবেন। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। নারীকে ক্ষমতায়িত করতে হলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে তাঁর ন্যায্য হিস্যাও নিশ্চিত করতে হবে।