জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আবাসিক হলে স্বামীকে আটক রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণের ঘটনায় আমরা স্তম্ভিত। এই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আগেও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। দেশের সেরা এই বিদ্যাপীঠে যদি নারী নিরাপদ না থাকেন, তাহলে তাঁরা কোথায় নিরাপদ থাকবেন?
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ নেতা মোস্তাফিজুর রহমান ধর্ষণ ঘটনার মূল হোতা। তিনি তাঁর বহিরাগত বন্ধু মামুনুর রশিদকে দিয়ে কৌশলে ওই দম্পতিকে ক্যাম্পাসে ডেকে আনেন। এরপর মোস্তাফিজের সহযোগী তিন শিক্ষার্থী ভুক্তভোগী নারীর স্বামীকে মীর মশাররফ হোসেন হলের একটি কক্ষে আটকে রাখেন এবং মোস্তাফিজ ও মামুন তাঁর স্ত্রীকে বোটানিক্যাল গার্ডেনসংলগ্ন জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করেন।
এই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যে ছয়জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে, তাঁদের মধ্যে তিনজনই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী। মোস্তাফিজ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের উপ-আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক, শাহ পরান সহসভাপতি, মুরাদ হোসেন সহসম্পাদক ও সাব্বির হাসান কার্যকরী সদস্য। তাঁরা সবাই বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আখতারুজ্জামান সোহেলের অনুসারী ও মীর মশাররফ হোসেন হলের বর্তমান ও সাবেক আবাসিক শিক্ষার্থী। তাঁদের কারও কারও ছাত্রত্ব অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে।
এদিকে ধর্ষণের ঘটনায় গ্রেপ্তার ছাত্রলীগের নেতা মোস্তাফিজুর রহমানসহ চারজনকে তিন দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়েছেন আদালত। ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (সিজেএম) আদালতের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রাবেয়া বেগম গত রোববার এ আদেশ দেন।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত মোস্তাফিজুর রহমানের সনদ স্থগিত এবং ক্যাম্পাসে তাঁকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে। একই শাস্তি দেওয়া হয়েছে মোস্তাফিজুরকে পালাতে সহায়তাকারী ৪৫তম ব্যাচের প্রাক্তন শিক্ষার্থী মো. হাসানুজ্জামানকে। একই ভূমিকায় আরেক প্রাক্তন শিক্ষার্থী ৪৪তম ব্যাচের শাহ পরানের সনদও স্থগিত করা হয়েছে।
সিন্ডিকেট সভায় আবাসিক হলে অবস্থানরত অবৈধ শিক্ষার্থীদের পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে হল ছাড়ার নির্দেশনা দিয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশসহ ওই সময়ের মধ্যে হল না ছাড়লে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ক্যাম্পাসে বহিরাগত ব্যক্তিদের প্রবেশ নিষেধ, ভাসমান দোকানপাট সরিয়ে দেওয়া ও ক্যাম্পাসে অনুমোদনহীন অটোরিকশা চলাচল নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েও বলতে চাই, যেখানে বর্তমান শিক্ষার্থীরা হলে আসন পান না, সেখানে প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা কীভাবে এত দিন হলে থাকলেন? বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কেন তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিল না? ক্যাম্পাস নিরাপদ রাখার দায়িত্ব কি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নয়?
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল এই ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দ্বারা ধর্ষণের মতো এহেন ন্যক্কারজনক কাজ, মাদকের সংশ্লিষ্টতা এবং এর সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের সম্পৃক্ততা দেশ ও জাতির জন্য চরম অবমাননাকর।’
সরকার বা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এই অবমাননাকর পরিস্থিতি চলতে দেবে, না দুর্বৃত্তদের আইনের আওতায় আনবে ও ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে—সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। এখনো সব আসামি গ্রেপ্তার হননি। পলাতক আসামিদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে অভিযুক্ত সবাইকে শাস্তির আওতায় আনা হোক।
অতীতেও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। সেখানে এক ছাত্রলীগ নেতা ধর্ষণে সেঞ্চুরি করার দাবির পরও তাঁকে আইনের আওতায় আনা হয়নি; বরং প্রভাবশালী ব্যক্তিরা তাঁকে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে যে শিক্ষার্থীরা ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, তাঁরা নানাভাবে নাজেহাল হয়েছিলেন।
তাই আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অভিযুক্তদের সাময়িক বহিষ্কার বা সনদ স্থগিত রাখাই যথেষ্ট নয়; ক্যাম্পাসকে শিক্ষার্থী কিংবা বহিরাগত সবার জন্য নিরাপদ রাখার দায়িত্ব তাদের। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস অপরাধীদের ‘অভয়ারণ্য’ হতে পারে না। ক্যাম্পাসে ধর্ষণের ঘটনার দায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এড়াতে পারে না।