সরকার পরিচালনার জন্য প্রচুর টাকার দরকার, এই কথা কেউ অস্বীকার করবে না। জাতীয় রাজস্ব বিভাগ বিভিন্ন সূত্র থেকে এই টাকা আদায় করে থাকে। যেমন নাগরিকের আয়, সম্পত্তি, ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর তারা কর ধার্য করে। তাই বলে চাকরিপ্রার্থীদের ওপরও বাড়তি করের বোঝা চাপিয়ে দিতে হবে?
১৭ আগস্ট অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের এক প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়, চাকরির আবেদনের ক্ষেত্রে মোবাইল অপারেটরের কমিশনের ওপর মূসক বা ভ্যাটের হার হবে ১৫। সাধারণত অনলাইনে আবেদন করা হয় সরকারি মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটর টেলিটকের মাধ্যমে। নিয়ম হলো, টেলিটক আবেদন ফির সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ কমিশন হিসেবে নিতে পারবে।
নবম গ্রেডের একটি চাকরির আবেদন ফি ৬০০ টাকা। এ ক্ষেত্রে টেলিটকের কমিশন হবে ৬০ টাকা। এই ৬০ টাকার ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ হবে, যার পরিমাণ ৯ টাকা। সব মিলিয়ে চাকরিপ্রার্থীর ব্যয় হবে ৬৬৯ টাকা। ভ্যাট আরোপের আগে বাড়তি ৯ টাকা লাগত না।
চাকরিপ্রার্থীরা আবেদন ফি কমানোর দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ক্যাম্পাসে তাঁরা মানববন্ধন করেছেন। একমাত্র বাংলাদেশ ব্যাংক ছাড়া কেউ আবেদন ফি কমায়নি। এখন সেই আবেদন ফির ওপর ভ্যাট আরোপ অনেকটা মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের শামিল।
সরকারের এই সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের টাকা সংগ্রহ বা আয়ের অনেক উৎস আছে। এই খাত থেকে ভ্যাট না নিয়ে সরকার তরুণদের প্রতি কিছুটা মানবিক আচরণ করতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হানও চাকরিপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে মূসক না নিলে ভালো হতো বলে মন্তব্য করেছেন।
একজন চাকরিপ্রার্থীর জন্য একবারের আবেদনে ৯ টাকা দেওয়া হয়তো বেশি নয়, কিন্তু একজন চাকরিপ্রার্থীকে চাকরি পেতে বহুবার আবেদন করতে হয়। প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, একজন চাকরিপ্রার্থী ৬০ বার আবেদন করে চাকরি পেয়েছেন। সে ক্ষেত্রে তাঁর বাড়তি খরচটি একেবারে কম নয়।
এর বাইরে চাকরির পরীক্ষার জন্য একজন প্রার্থীকে বাড়ি থেকে চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার খরচও জোগাতে হয় টিউশনি কিংবা অভিভাবকের কাছ থেকে টাকা এনে। সে ক্ষেত্রে একজন চাকরিপ্রার্থীর জন্য ভ্যাটের বাড়তি বোঝা অমানবিকই বটে।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব যাদের মানবিক হতে বলেছেন—রাজস্ব বিভাগ, চাকরিপ্রার্থীদের প্রতি মানবিক না হয়ে যাঁরা সরকারের কোটি কোটি টাকা কর ফাঁকি দেন, তাঁদের প্রতিই অতি মানবিক আচরণ করে থাকে। কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য হলো যাঁর আয় বেশি, তাঁর কাছ থেকে বেশি কর আদায় করা।
আর যাঁর আয় নেই, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগেই তাঁর ন্যূনতম চাহিদাগুলো পূরণ করা। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই অনেক রাষ্ট্র বেকার ভাতা দিয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকেরা তেলা মাথায় তেল দেওয়ার নীতিকেই শ্রেয় বলে মনে করেন।
এই প্রেক্ষাপটে আমাদের দাবি, অর্থ বিভাগের ১৭ আগস্টের প্রজ্ঞাপনটি বাতিল করে চাকরিপ্রার্থীদের বাড়তি করের বোঝা থেকে রেহাই দেওয়া হোক। সেই সঙ্গে চাকরিপ্রার্থীদের আবেদন ফি যথাসম্ভব আরও কমানো হোক। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারলে অন্যরা কেন পারবে না?