বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়া, মার্কিন ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদি নানা কারণে বাজারে প্রায় সব ভোগ্যপণ্যের দাম চড়া। কোনো পণ্যের দাম আগে থেকেই বেশি। আবার কোনোটির দাম সাম্প্রতিক কালে বেড়ে উচ্চ মূল্যে স্থিতিশীল আছে। এখন অনেকটা লাগামছাড়া চিনির দাম। দফায় দফায় বৈঠক-আলোচনা, পরামর্শ, নির্দেশনা—কোনো কিছুই কাজে লাগছে না। সাধারণ ভোক্তার কাছে এই মিষ্টিপণ্যটি তেতো মনে হওয়াও অস্বাভাবিক নয়।
চিনির মূল্যবৃদ্ধির জন্য খুচরা ব্যবসায়ীরা আমদানিকারকদের দায়ী করছেন। অন্যদিকে আমদানিকারকেরা আন্তর্জাতিক বাজারের ঊর্ধ্বগতি, বন্দরে সময়মতো পণ্য খালাস না হওয়া এবং ডলারের বিপরীতে টাকার মানের অবমূল্যায়নের কথা বলছেন।
গত সোমবার বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি) বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছিল, খুচরা বাজারে প্রতি কেজি খোলা চিনি বিক্রি হতে পারে ১২০ টাকা দরে। আর প্যাকেটজাত চিনির দাম হতে পারে ১২৫ টাকা। বিটিটিসির সুপারিশ করা দর কার্যকর করতে চিনিকলমালিকদের সমিতিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চিঠিও দিয়েছে। কিন্তু বাজারে প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা দরে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গত ৬ এপ্রিল প্রতি কেজি খোলা চিনির দাম ৩ টাকা কমিয়ে ১০৪ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছিল। সেই দামে তখন চিনি বিক্রি হয়নি। এর আগে গত ফেব্রুয়ারিতে চিনি আমদানির শুল্ক কমানো হয়, যার মেয়াদ এই মাসেই শেষ হবে। রোজায় চিনির চাহিদা বেশি থাকায় দামও বেশি ছিল। কিন্তু রোজা-ঈদ শেষ হওয়ার পরও চিনির বাজারের ঊর্ধ্বগতির কারণ কী? সরকারের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরাও যখন ‘সিন্ডিকেটের’ কথা বলেন, তখন সেটি ভেঙে দেওয়ার দায়িত্ব কি তঁাদের নয়?
বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের কাছে এখন খোলাবাজারে ছাড়ার মতো যথেষ্ট চিনি নেই। অথচ এই সংস্থাকে সুরক্ষা দিতে চিনি আমদানিতে উচ্চ হারে শুল্ককর আরোপ করে রাখা হয়েছে। এখন উৎপাদনকারীদের ক্ষেত্রে অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে মোট করভার প্রায় ৪৭ শতাংশ। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এক কেজি চিনিতে প্রায় ৩৫ টাকা কর দাঁড়াচ্ছে।
দেশে বছরে চিনির চাহিদা ১৮ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে চিনি শিল্প করপোরেশনের মিলগুলো উৎপাদন করেছে (২০২১-২২) ২৫ হাজার টনের কম। সরকারের উচিত ছিল সরকারি চিনিকলগুলোকে নবায়ন ও বহুমুখী করা। কেবল চিনি উৎপাদন করে এগুলো টিকিয়ে রাখা কঠিন।
চিনিকলের উপজাত চিটাগুড় ও ঝোলাগুড় থেকে বিপুল পরিমাণে মিথাইল ও ইথাইন অ্যালকোহল আহরণ সম্ভব। প্রতিবেশী ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কায় এসব পণ্য রপ্তানির সম্ভাবনা আছে। ওষুধশিল্পেও এর বিপুল ব্যবহার আছে।
চিনির মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে ব্যবসায়ীরা যেসব অজুহাত দেখাচ্ছেন, তা কতটা বিশ্বাসযোগ্য? আমদানিকারকেরা অপরিশোধিত চিনি এনে দেশে পরিশোধন করেন। সে ক্ষেত্রে আমদানি মূল্য জানা গেলেও মিলের খরচ তাঁরা যেটি বলেন, সেটাই মেনে নিতে হয়।
বাণিজ্যসচিব চিনির বাজার স্থিতিশীল রাখতে গত বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে বৈঠকে করেছেন, যাতে বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), শিল্প মন্ত্রণালয়, বিটিটিসি, বাংলাদেশ পুলিশের বিশেষ শাখা, অপরাধ তদন্ত বিভাগ, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা অধিদপ্তরের প্রতিনিধিসহ অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
এ ধরনের বৈঠকে কত সংস্থার কতজন প্রতিনিধি উপস্থিত হয়েছেন, তা গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ হলো সেই বৈঠক থেকে কী ফল পাওয়া যাবে। কেবল বৈঠক করে চিনির বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না; নিয়মিত তদারকির কাজটিও জোরদার করতে হবে।
মার্কিন ডলার–সংকটের কারণে বন্দরে জাহাজ থেকে পণ্য খালাসে বিলম্ব হয় বলে আমদানিকারকেরা যে অভিযোগ করেছেন, তা বিবেচনায় নিতে হবে। এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে। চিনি নিয়ে সমস্যার যৌক্তিক কারণ রয়েছে নাকি এটি একটি কৌশল, তা–ও খুঁজে বের করতে হবে।