নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক অঙ্গন আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। গত সপ্তাহে সরকারি ও বিরোধী দলের সমাবেশ-মহাসমাবেশ বেশ শান্তিপূর্ণভাবেই অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু গত শনিবার বিএনপির অবস্থান কর্মসূচি ঘিরে সংঘাত-সংঘর্ষ, গ্রেপ্তার ও জখম হওয়ার ঘটনা দেশের শান্তিকামী মানুষের সঙ্গে আমাদেরও উদ্বিগ্ন করে।
এখানেই ঘটনা শেষ নয়। বিএনপির ‘সন্ত্রাস-অগ্নিসংযোগের’ বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ রোববার সারা দেশে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছে। অন্যদিকে বিএনপি সরকারের ‘দমন–পীড়নের’ বিরুদ্ধে আজ জেলা ও বিভাগীয় শহরে গণসমাবেশের ডাক দিয়েছে।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হয়ে থাকে আলোচনার টেবিলে। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব রাজপথেই সবকিছু ফয়সালা করতে চায়। রাজপথে ফয়সালার জন্য রাষ্ট্র ও জনগণকে যে ক্ষতির শিকার হতে হয়, তা অপূরণীয়। এরশাদের আমলে সুষ্ঠু ভোটের জন্য আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একত্র হয়ে আন্দোলন করে সফল হয়েছে।
বিএনপির আমলে জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে নিয়ে আওয়ামী লীগ আন্দোলন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে। সেই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বিএনপি আমলে বিতর্কিত করার কারণে ২০০৭ সালে এক-এগারোর পালাবদল ঘটে। পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাই বাতিল করে দেয়; যদিও সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে সংসদ চাইলে এর অধীনে দুটি নির্বাচন করার কথা বলা হয়েছিল।
সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল হওয়ার পর ২০১৪ ও ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত দুটি নির্বাচন নিয়েই প্রবল বিতর্ক হয়। এবারও নির্বাচন সামনে রেখে উন্নয়ন সহযোগীরা সোচ্চার হয়েছে। তারা সুষ্ঠু, অবাধ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের তাগিদ দিয়ে আসছে। কেবল বিদেশিরা নয়, দেশের মানুষও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে চায়।
আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো রাজপথে শক্তি প্রদর্শন করে জনপ্রিয়তা প্রমাণ করতে চায়। কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভোটই হলো জনপ্রিয়তা প্রমাণের একমাত্র উপায়। যদি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি রাজনৈতিক নেতৃত্বের ন্যূনতম আস্থা থেকে থাকে, তাদের উচিত হবে রাজপথের হানাহানি বন্ধ করে আলোচনার টেবিলে বসে নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট সমস্যার সমাধান করা। এ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদেরই উদ্যোগী ভূমিকা নিতে হবে। গণতন্ত্রের প্রত্যয় নিয়ে যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেখানে নির্বাচন নিয়ে পাঁচ বছর পরপর এই হাঙ্গামা হবে কেন?
রাজনৈতিক দলগুলো যখন রাজপথে শক্তি পরীক্ষায় ব্যস্ত, তখন দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা কী। মূল্যস্ফীতির চাপে সাধারণ মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ায় অর্থনীতি ভীষণ চাপে আছে। এ অবস্থায় রাজপথে কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সংঘাত হলে পরিস্থিতি শোচনীয় ও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
নির্বাচন নিয়ে দুই পক্ষের অনড় অবস্থান দেশকে গভীর অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। যে-ই রাজনৈতিক নেতৃত্ব হোক, সেটি সরকারি কিংবা বিরোধী দলের, জনগণের কল্যাণে কাজ করেন, তাঁরা কোনোভাবে রাজপথে সংঘাত জিইয়ে রাখতে পারেন না। বিএনপির গণসমাবেশের দিন পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ প্রত্যাহার করেছে।
আমরা দীর্ঘদিন ধরেই পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি না দেওয়ার কথা বলে আসছিলাম। বিলম্বে হলেও ক্ষমতাসীনদের যদি সত্যিই এই বোধোদয় হয়ে থাকে, তবে আমরা তাকে সাধুবাদ জানাই। সব ক্ষেত্রে এই সদিচ্ছা প্রদর্শন করলে রাজনীতিতে সংঘাত এড়ানো কঠিন নয়।
নির্বাচনের বাকি মাত্র পাঁচ-ছয় মাস। অবিলম্বে রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত রাজপথের কর্মসূচি পরিহার করে আলোচনার টেবিলে বসে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি সমাধানে আসা। এ বিষয়ে উভয় পক্ষের দায়িত্ব থাকলেও সরকারকেই উদ্যোগী ভূমিকা নিতে হবে।