ধারণা করা হয়েছিল যে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পর শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের শান্তিপূর্ণ ও যৌক্তিক পরিসমাপ্তি ঘটবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সারা দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে। শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে দেওয়া আট দফা দাবিতেও অবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়া এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা বলা হয়েছিল।
উল্লেখ্য যে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় সংঘর্ষে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে দুই শতাধিক মানুষের মৃত্যু ও কয়েক হাজার মানুষের আহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। বিপুল পরিমাণ রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস হয়।
আমাদের প্রত্যাশা ছিল, পরিস্থিতির দ্রুত উন্নয়নে সরকার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনায় বসে দ্রুত সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেবে। মন্ত্রীদের পক্ষ থেকে সে রকম ইঙ্গিতও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করলাম যে আন্দোলনকারীদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টির লক্ষ্যে নানা রকম কৌশলের আশ্রয় নেওয়া হলো।
আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামসহ বেশ কয়েকজনকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে তাঁদের ওপর নির্যাতন করার অভিযোগ আছে। এরপর যে ঘটনা ঘটেছে, সেটি আরও উদ্বেগজনক। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তিন সমন্বয়ককে ডিবি (গোয়েন্দা বিভাগ) অফিসে নিয়ে আসা হয় চিকিৎসা শেষ না করেই। ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ দাবি করেছেন যে তাঁদের নিরাপত্তার জন্যই এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। যদিও কোনো সমন্বয়ক নিরাপত্তা চেয়েছেন, সে রকম কোনো তথ্যপ্রমাণ নেই। তাঁদের ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি জবরদস্তিমূলক হিসেবে বিবেচনা করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
প্রশ্ন হলো, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এভাবে কাউকে নিয়ে আসতে পারে কি না? ডিবি অজুহাত হিসেবে দেখিয়েছে যে একজন সমন্বয়কের বাবা তাঁদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। এটা স্পষ্ট যে তাঁদের উদ্বেগটা আসলে খোদ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিয়েই। কারণ, তঁাদের বিরুদ্ধেই সমন্বয়ককে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া ও মারধর করার অভিযোগ রয়েছে।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা কর্মসূচি প্রত্যাহার করেছেন, এ রকম একটি ঘোষণা এসেছে। কিন্তু সেটা ডিবি অফিসে তথাকথিত ‘নিরাপত্তা হেফাজতে’ থাকার সময় কেন? তাঁরা স্বেচ্ছায় কর্মসূচি প্রত্যাহার করলে বাইরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস বা অন্য কোনো স্থান থেকেই করতেন। ডিবি অফিসে ছয় সমন্বয়ককে নিয়ে যাওয়া এবং তাঁদের খাবারের দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার মধ্যে যে সৎ উদ্দেশ্য নেই, তা স্পষ্ট।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘কথিত আটক’ ছয় সমন্বয়ককে অবিলম্বে মুক্তি দিতে এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি না চালাতে নির্দেশনা চেয়ে গতকাল সোমবার রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের দুই আইনজীবী মানজুর-আল মতিন ও আইনুন্নাহার সিদ্দিকা। এ বিষয়ে বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি এস এম মাসুদ হোসাইন দোলনের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ সরকারপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ‘এগুলো করতে আপনাকে কে বলেছে? কেন করলেন এগুলো? জাতিকে নিয়ে মশকরা কইরেন না। যাকে নেন ধরে, একটি খাবার টেবিলে বসিয়ে দেন।’
সরকার একদিকে শিক্ষার্থীদের প্রতি কর্মসূচি প্রত্যাহার করার আহ্বান জানাচ্ছে, অন্যদিকে তাঁদের মধ্যে ভীতি তৈরির সব উদ্যোগ অব্যাহত রেখেছে। কয়েকজন সমন্বয়ককে ডিবি অফিসে নিয়ে আটকে রাখায় অন্য সমন্বয়কদের মধ্যেও ভয় ঢুকে যাওয়ার কথা। এভাবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা যায় না, শিক্ষার্থীদের আস্থা অর্জনের পথও এটা নয়।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হলে এখনই সরকারকে বলপ্রয়োগের নীতি থেকে সরে আসতে হবে। মুখে এক কথা বলে কার্যত অন্য পথ ধরার নীতি থেকে সরে আসতে হবে। আস্থার পরিবেশ তৈরির এটাই একমাত্র পথ।