প্রশ্রয়দাতাদের আইনের আওতায় আনা হোক

সম্পাদকীয়

রাজনৈতিক প্রভাব ছাড়া অপরাধী চক্র গড়ে উঠতে পারে না। প্রতিটি অপরাধী চক্রের পেছনে কোনো না কোনো ক্ষমতাধরের আশীর্বাদ ও প্রশ্রয় থাকে। আবার সেই আশীর্বাদ ও প্রশ্রয়ের পেছনেও ‘বিনিময় মূল্য’ থাকে। কখনো তাদের রাজনৈতিক সমাবেশে লোক আনার দায়িত্ব দেওয়া হয়, কখনো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার কাজে লাগানো হয়।

১৩ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোয় রাজধানীর এলাকাভিত্তিক অপরাধী চক্রের যে খবর ছাপা হয়েছে, তা রীতিমতো ভয়ংকর। এলাকাভিত্তিক এসব অপরাধী চক্র ‘কিশোর গ্যাং’ নামে পরিচিত হলেও এদের কেউ কিশোর নয়। ১৯ থেকে ২৫ বছর বয়সী এসব অপরাধী নানা অপকর্ম করে থাকে।

প্রথম আলোর সর্বশেষ অনুসন্ধান অনুযায়ী ঢাকায় কথিত কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা ৮০। গত বছর জুন মাসে একই পত্রিকার প্রতিবেদনে রাজধানীতে ৫২টি কিশোর গ্যাংয়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। কিন্তু আট মাসের ব্যবধানে কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা দেড় গুণের বেশি বেড়ে যাওয়ার কারণ কী?

ঢাকা শহরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশই (ডিএমপি) এই তথ্য দিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আরও যে উদ্বেগজনক তথ্য দিয়েছে, তা হলো এসব কিশোর গ্যাংয়ের পেছনে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি অর্থাৎ কাউন্সিলরদের প্রশ্রয় আছে। প্রথম আলোর প্রতিবেদনে ডিএমপির বরাতে ২১ কাউন্সিলের নাম এসেছে। এর বাইরেও যে আশ্রয় ও প্রশ্রয়দাতা নেই, তা হলফ করে বলা যায় না। আগে স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন হতো নির্দলীয়ভাবে।

সেখানে সব দলের সমর্থক তথা নেতা-কর্মীরা অংশ নিতেন। কিন্তু স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হওয়ার পর থেকে সেখানে বিরোধী দলের প্রতিনিধি নেই বললেই চলে, মেয়র–কাউন্সিলর উভয় পদে। ঢাকা শহরের ৯৫ শতাংশ কাউন্সিলর ক্ষমতাসীন দলের। সে ক্ষেত্রে এলাকার উন্নয়ন হলে যেমন তাঁরা কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন, তেমনি মন্দ কাজের বদনামও তাঁদের নিতে হবে।

অভিযুক্ত কাউন্সিলররা নিজেকে ধোয়া তুলসীপাতা দাবি করলেও নানা তথ্য-প্রমাণে দেখা যায়, এলাকাভিত্তিক কিশোর অপরাধী চক্রের সদস্যদের সঙ্গে তাঁদের সখ্য আছে। অনেক সময় এদের কারও নামে মামলা হলে তাঁরা থানা-পুলিশে তদবিরও করে থাকেন। এই অপরাধীরা কেবল চাঁদাবাজি নয়; হত্যা, ছিনতাই, মাদক ব্যবসা, জমি ও বাড়ি জবরদখলের সঙ্গেও জড়িত। ভুক্তভোগীরা মামলা করলেও প্রতিকার না পেয়ে উল্টো মারধরের শিকার হন। ২০২৩ সালেই ঢাকা শহরে অন্তত ২৫টি খুনের সঙ্গে কথিত কিশোর গ্যাংয়ের জড়িত থাকার খবর পাওয়া গেছে।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা এলাকাভিত্তিক অপরাধের দায় কোনোভাবে এড়াতে পারেন না। যদি তাঁরা ব্যক্তিগতভাবে এসব অপরাধী চক্রকে আশ্রয়–প্রশ্রয় না–ও দিয়ে থাকেন, তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিয়েছেন? অপরাধীদের ধরতে কি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সহায়তা করেছেন? করেননি। বরং অনেক ক্ষেত্রে এলাকার ছেলে হিসেবে অপরাধীদের ছাড়াতে থানা-পুলিশে তদবিরও তাঁরা করে থাকেন।

এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। ঢাকায় এত সব অপরাধী চক্র একের পর এক দুর্ধর্ষ অপরাধমূলক কাজ করে চললেও অপরাধীদের শাস্তির উদাহরণ খুবই কম।

এই যে ঢাকা শহরে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য বেড়ে চলেছে, তার বিরুদ্ধে ডিএমপি বা থানা-পুলিশকে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। অনেক ক্ষেত্রে থানা-পুলিশের পক্ষ থেকে মামলায় নিরুৎসাহিত করা হয়। মামলা হলেও অপরাধীরা শাস্তি পায় না সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে।

এলাকাভিত্তিক অপরাধী চক্রকে ঠান্ডা করতে হলে তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে।