অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে জনপ্রশাসনে যে অস্থিরতা চলে আসছিল, ৫৯ জেলায় নতুন জেলা প্রশাসককে কেন্দ্র করে সেটা আরও ঘনীভূত হয়েছে। মঙ্গলবার পদবঞ্চিত কর্মকর্তারা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে গিয়ে এসএসবির সদস্যসচিবের কাছে কৈফিয়ত দাবিকরণে হট্টগোলের সৃষ্টি হয়। পরে এটা হাতাহাতিতে রূপ নেয় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন। এমনকি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ডাকতে হয়।
পদবঞ্চিত কর্মকর্তাদের দাবি, আওয়ামী লীগ আমলে যেসব কর্মকর্তা সুবিধা পেয়ে এসেছেন, তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে জেলা প্রশাসক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবারের গোলযোগ বুধবার পর্যন্ত চলে এবং কর্মকর্তাদের বিক্ষোভের মুখে নবনিযুক্ত ডিসিদের মধ্যে আটজনের নিয়োগ বাতিল ঘোষণা করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এর আগে পদবঞ্চিত কর্মকর্তাদের সঙ্গে জনপ্রশাসনসচিব মো. মোখলেস উর রহমান বৈঠক করেন।
নিয়োগ বাতিল হওয়ায় কর্মকর্তারা আগে যে যেখানে কর্মরত ছিলেন, সে সেখানেই কাজ করবেন বলে জানানো হয়েছে। এটা সংশ্লিষ্টদের জন্য স্বস্তিকর নয়।
জনপ্রশাসনে বদলি ও পদায়ন হয়ে থাকে নির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে। এখানে সেই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেছে বলে ধারণা করি। এভাবে যদি কেউ বিক্ষোভ করে পদায়ন ঠেকাতে পারেন, তাহলে এই ধারা তো চলতে থাকবে এবং প্রশাসনে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। প্রশ্ন হলো কর্তৃপক্ষের আগের সিদ্ধান্ত কি ভুল ছিল? যদি ভুল না হয়ে থাকে, তাহলে তঁারা পরবর্তী সময়ে সেটি কিসের ভিত্তিতে বদলালেন?
প্রশাসনের যেকোনো কর্মকর্তা নিজেকে পদবঞ্চিত মনে করতে পারেন। কিন্তু তার প্রতিকারের জন্য নিয়মনীতি আছে, সেটা অনুসরণ না করে চাপ দিয়ে নিয়োগ বাতিল বা পদায়ন খুবই অন্যায় বলে মনে করি।
সচিবালয় হলো জনপ্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র। সেখানে যদি এ রকম বিক্ষোভ-বিশৃঙ্খলার ঘটনা ঘটে, তাহলে মাঠপর্যায়ের প্রশাসনেও তার প্রভাব পড়বে। মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা যদি কোনো কোনো কারণে নবনিযুক্ত জেলা প্রশাসককে পছন্দ না করেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন, তাহলে কি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় তাঁর নিয়োগ বাতিল করবে?
জনপ্রশাসনে এভাবে বিক্ষোভ করে নিয়োগ বাতিলের ঘটনা অতীতে কখনো ঘটেনি বলে জানিয়েছেন একজন সাবেক সচিব।
কেবল জেলা প্রশাসক নিয়োগ নয়, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার অব্যবহিত পর বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দপ্তরেও জোর করে অনেকের পদত্যাগ ও রদবদলের ঘটনা ঘটেছে। আগের সরকারের আমলে পদায়নের ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম হলে আরেকটি অনিয়ম দিয়ে তার প্রতিকার হতে পারে না।
যেহেতু অন্তর্বর্তী সরকার ছাত্র গণ-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন, সেহেতু তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ নিতে হবে চিন্তাভাবনা করে, কর্মকর্তাদের অতীত রেকর্ড দেখে। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক কর্মকর্তাদের তাঁদের পেশাগত দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও সততাই বিচার্য। সংশ্লিষ্টদের মনে রাখা দরকার, অতীত সরকারের নীতি ও নির্দেশ মেনে সব কর্মকর্তাই কাজ করেছেন। দেখার বিষয় ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুযোগে কেউ বাড়তি সুবিধা নিয়েছেন কি না, অন্যদের প্রতি অবিচার করেছেন কি না?
ক্ষমতার পালাবদলের পর একশ্রেণির কর্মকর্তা নিজেদের আগের সরকারের আমলে বঞ্চিত বলে দাবি করে আসছেন। এই দাবির পেছনে আসলেই কোনো তথ্যপ্রমাণ আছে, না তাঁরা নতুন সরকারের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে অন্যায় সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করছেন, সেটাও সরকারকে খতিয়ে দেখতে হবে।
প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফিরে না এলে সরকার সংস্কার ও সুশাসনের যেসব উদ্যোগ হাতে নিয়েছে, তা-ও ভেস্তে যাবে।