সুন্দরবনের কর্মকর্তাদের লাগাম টানুন

সম্পাদকীয়

যে অনিয়ম বছরের পর বছর ধরে চলে এবং কোনো ধরনের বাধার মুখে পড়ে না, সেই অনিয়ম একসময় নিয়মানুবর্তিতার মর্যাদা পায়। সেটি যে অনিয়ম, তা বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যায়। অনিয়ম নিয়ম হয়ে ওঠে। অনিয়মে জড়িত সব পক্ষের যাবতীয় অপরাধবোধ লুপ্ত হয়। তখন তারা অপরাধবোধ ও আত্মগ্লানির অনলস্পর্শ ছাড়াই অপরাধ-অনিয়ম সংঘটনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে।

সুন্দরবনের বন কর্মকর্তাদের এমন দশা দৃশ্যমান হয়েছে। সেখানে তাঁরা বনজীবী জেলেদের নৌকা নিয়ে বনে প্রবেশের অনুমতিপত্র (বিএলসি) নবায়ন করার সময় নির্ধারিত রাজস্বের চেয়ে ৪০ গুণ বেশি অর্থ ঘুষ হিসেবে নিচ্ছেন। হয়রানি থেকে বাঁচতে এবং নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার ও কাঁকড়া ধরার অলিখিত অনুমতি পেতে জেলেরা বনকর্মীদের এই ঘুষ দিয়ে বনে প্রবেশ করছেন। এই ঘুষের ‘রেওয়াজ’ এতটাই প্রতিষ্ঠিত যে এ বিষয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে কোনো লুকোছাপা নেই।

প্রথম আলোর প্রতিবেদকের কাছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ঘুষ নেওয়ার বিষয়ে শুধু নির্বিকার ও সরল স্বীকারোক্তিই দেননি, আত্মপক্ষ সমর্থনে তাঁরা এই ঘুষ গ্রহণের ‘যৌক্তিকতাও’ তুলে ধরেছেন। তাঁদের ভাষ্য থেকে সহজেই অনুমেয়, জেলেদের কাছ থেকে ঘুষ নেওয়াকে তাঁরা অন্যায্য বা অনৈতিক বা বেআইনি সাব্যস্ত করতে নারাজ। ফলত তাঁদের কাছে অনুশোচনার প্রত্যাশা অর্থহীন।

প্রতিবেদন বলছে, বিএলসি নবায়নে সরকার প্রতি ২৫ মণ ধারণক্ষমতার একটি নৌকার জন্য ১৫ টাকা পর্যন্ত রাজস্ব নির্ধারণ করে দিলেও বন কর্মকর্তারা তাঁদের কাছ থেকে ৬০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করছেন। বছরের পর বছর ধরে এই অবস্থা চলছে।

একজন কর্মকর্তার ভাষ্য, ‘রাজস্বের বেশি টাকা নেওয়া হয়, এটা ঠিক। তবে জেলেদের কাছ থেকে জোর করে নেওয়া হয় না। টাকা দিতে জেলেরা আপত্তিও করেন না। আমরাও জেলেদের সুযোগ-সুবিধা দেখি। জেলেরা নিষিদ্ধ জাল, বরফ, দা-কুড়াল নিয়ে বনে ঢোকে, আমরা দেখেও দেখি না।’ আরেক কর্মকর্তারা ভাষ্য, ‘দীর্ঘদিন ধরে এভাবেই চলে আসছে। তবে এই সংস্কৃতি থেকে বের হওয়া দরকার।’ কর্মকর্তারা বলছেন, ঘুষের টাকার ভাগ পান ঊর্ধ্বতনরাও।

বাস্তবতা হলো, ঘুষ না দেওয়া হলে জেলেদের বনের মধ্যে নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়। হতদরিদ্র জেলেদের যেহেতু আর কোনো পেশা বেছে নেওয়ার সুযোগ নেই, ফলে এই অনিয়মকেই তাঁরা নিয়তি হিসেবে মেনে নিচ্ছেন।

দেশে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির পটভূমিতে অঙ্কের দিক থেকে এটিকে ছোট দুর্নীতি বলে মনে হতে পারে। তবে মনে রাখা দরকার, এখানে যাঁরা ভুক্তভোগী, তাঁরা গরিবের মধ্যে গরিব। তাই তাঁদের রক্ত পানি করা টাকা শুষে নেওয়ার বিষয়ে শূন্য সহিষ্ণু নীতি অনুসরণ করতেই হবে।