পাখি শিকার ও শিকারিদের দৌরাত্ম্যের বিষয়টিই বারবার খবর হতে দেখি আমরা। এখানে আলাদা শিকারি বাহিনীও গড়ে উঠেছে, যাদের পেশাই হচ্ছে পাখি শিকার করা। এমন পরিস্থিতির মধ্যে পাবনার বেড়া উপজেলার এক ব্যক্তি জঙ্গলঘেরা বাড়ির মধ্যে তৈরি করেছেন পাখির অভয়াশ্রম। পাখিদের নিয়মিত খাওয়ান, সেগুলোকে শিকারিদের থেকে আগলে রাখেন তিনি। অশীতিপর আকাশকলি দাস স্থানীয়ভাবে ‘পাখিবন্ধু’ হিসেবেই পরিচিত। পাখিকে ভালোবাসা ও পাখি রক্ষার বিষয়টি তিনি যেভাবে এলাকায় ছড়িয়ে দিয়েছেন, তা খুবই আশাব্যঞ্জক।
আকাশকলি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। বেড়া উপজেলা সদর থেকে আট কিলোমিটার দূরে কৈটোলা গ্রামে তাঁর বাড়ি। বাড়িটির আয়তন সাড়ে পাঁচ বিঘা। এক বোন ছাড়া অসংখ্য পাখিই হচ্ছে চিরকুমার আকাশকলির পরিবার ও স্বজন। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া বিশাল বাড়িটির বেশির ভাগই জঙ্গলে ভরা। সেখানে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির বড় বড় গাছ। জঙ্গল ও গাছ ঘিরে পাখিদের এক নিরাপদ আবাসস্থল গড়ে তুলেছেন আকাশকলি। নিয়মিত পাহারা দিয়ে শিকারিদের এ বাড়ির কাছ ঘেঁষতে দেন না তিনি। এখানে পাখির মধ্যে বেশি দেখা যায় দেশি বক, কানিবক, পানকৌড়ি, শামুকখোল, ঘুঘু, দোয়েল, শালিক, ছোট সরালি, বড় সরালি, খঞ্জনা ও পাতিহাঁস। শীত মৌসুমে তো পরিযায়ী পাখি দেখতে বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ বাড়িতে ভিড় করেন।
বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়া আকাশকলির দিনের বেশির ভাগ সময় কাটে বাড়ির পাখির পরিচর্যায়। তিনি এখনো পাখিদের প্রতিদিন খাবারের ব্যবস্থা করে যাচ্ছেন। নিরাপদ আশ্রয় ও খাবার পেয়ে পাখির সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। আকাশকলি প্রথম আলোকে বলেন, ‘পাখিদের না খাইয়ে খেতে ইচ্ছা করে না। ওরা আমার সন্তানের মতো। আসলে ওরা ভালোবাসা বোঝে। তাই আমার বাড়িতে এসে ওরা ভিড় করে।’
আকাশকলির বাড়িতে পাখির এ মিলনমেলার বিষয়টি সরকারি–বেসরকারি সংশ্লিষ্ট মহলের নজরে আসে। পাখির আবাসস্থলটি নিয়ে পরিবেশবাদী বেসরকারি সংগঠন (এনজিও) আইইউসিএন কিছু কর্মসূচি হাতে নেয়। তাদের সহযোগিতা ও প্রচেষ্টায় ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে মৎস্য অধিদপ্তরের একটি প্রকল্পের অধীনে বাড়িটিকে ‘পাখি অভয়াশ্রম’ ঘোষণা করে। দুঃখজনক হচ্ছে, ‘অভয়াশ্রম’ ঘোষণা করা হলেও এ ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে সেখানে বিশেষ কোনো সহযোগিতা ও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
বন উজাড় ও পরিবেশ ধ্বংসের কারণে দিন দিন পাখির আবাসস্থল কমে আসছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পরিযায়ী পাখির সংখ্যাও কমে এসেছে পাখির স্বর্গ হিসেবে পরিচিত হাওর–বাঁওড়, বিল–হ্রদের মতো জায়গাগুলোতে। সরকারিভাবে এ ব্যাপারে খুব একটা উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তাও আমরা দেখি না। আকাশকলিদের মতো মানুষেরা প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সুরক্ষায় আমাদের জন্য বড় অনুপ্রেরণা। পাখির আবাসস্থলটিকে একটি অভয়াশ্রম হিসেবে গড়ে তোলার জন্য যাবতীয় পদক্ষেপ নেওয়া হোক।