বাংলাদেশ তৈরি পোশাকশিল্প মালিক সমিতির (বিজিএমইএ) চট্টগ্রাম অঞ্চলের নেতারা গত শনিবার সংবাদ সম্মেলন করে যেসব সমস্যার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, সরকারের উচিত সেগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা। তাঁদের উত্থাপিত দাবিদাওয়ার মধ্যে কিছু আঞ্চলিক বিষয় থাকলেও বেশির ভাগই পুরো দেশের শিল্পকারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য প্রযোজ্য।
চট্টগ্রামের শিল্পমালিকদের অভিযোগ, গেল শতকের আশির দশকে চট্টগ্রাম থেকেই তৈরি পোশাকশিল্পের যাত্রা শুরু হলেও সরকারের বিমাতাসুলভ আচরণের কারণে তাঁরা এখন পিছিয়ে পড়েছেন। বিজিএমইএর পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত দেশের মোট তৈরি পোশাক রপ্তানির প্রায় ৪০ শতাংশ হতো চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে। বর্তমানে সেটি ১৫ শতাংশে নেমে এসেছে। অস্বীকার করার উপায় নেই যে দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরের কাছাকাছি স্থানে শিল্পকারখানা গড়ে উঠলে যন্ত্রপাতি আমদানি ও উৎপাদিত পণ্য রপ্তানির খরচ কম পড়ে। শেষ বিচারে ভোক্তারা লাভবান হয়।
শিল্পমালিকদের অভিযোগ, ব্যাংকঋণ থেকে শুরু করে আমদানি-রপ্তানির প্রায় সব বিষয়ে সিদ্ধান্তের জন্য তাঁদের ঢাকার দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। সরকার মুখে বিকেন্দ্রীকরণের কথা বললেও বাস্তবে ঘটছে তার উল্টো। অতীতে কয়েকটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় চট্টগ্রামে ছিল, এখন সবকিছু ঢাকায় কেন্দ্রীভূত। এমনকি বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর অফিসও চট্টগ্রাম থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এ অবস্থায় চট্টগ্রামের শিল্পমালিক ও ব্যবসায়ীদের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে।
চট্টগ্রামের শিল্পমালিকেরা সুষম উন্নয়নের স্বার্থে চট্টগ্রাম অঞ্চলে পোশাকপল্লি স্থাপন, ব্যাংকের বিনিয়োগবান্ধব উদ্যোগী ভূমিকা নেওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন; চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো, শিল্পকারখানায় নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং অর্থনৈতিক অঞ্চলে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সমান সুবিধা দেওয়ার দাবি উত্থাপন করেছেন। তাঁদের এসব দাবি অযৌক্তিক নয়। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির যুগে সরকারি সিদ্ধান্ত পেতে সবাইকে ঢাকায় আসার যুক্তি নেই।
চট্টগ্রামের শিল্পমালিকেরা চট্টগ্রাম বন্দরের অবকাঠামোর সুবিধা বাড়ানোর পাশাপাশি বন্দরের কার্যক্রমকে অত্যাবশ্যকীয় বা জরুরি সেবা ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন, যাতে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কেউ কথায় কথায় ধর্মঘট ডাকতে না পারে। কয়েক দিন আগে পরিবহনমালিক ও শ্রমিকেরা ধর্মঘট ডাকলে ৩৫ ঘণ্টা বন্দরে পণ্য খালাস ব্যাহত হয়। পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর পরিবহনমালিক ও শ্রমিকনেতারা কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নিলেও অনেক ক্ষতি হয়েছে। করোনা সংকটকালে দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরের কার্যক্রম এক মিনিটের জন্যও বন্ধ থাকতে পারে না। সে ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রমকে অত্যাবশ্যকীয় বা জরুরি সেবা ঘোষণা করার দাবি অবশ্যই যৌক্তিক।
শিল্পমালিকেরা যে শিল্পকারখানায় নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহের দাবি জানিয়েছেন, তা সারা দেশের জন্যই প্রযোজ্য। সরকারের দাবি, দেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির কোনো সমস্যা নেই। তাহলে চট্টগ্রাম অঞ্চলসহ সারা দেশে শিল্পকারখানাগুলো প্রয়োজনীয় গ্যাস-বিদ্যুৎ পাবে না কেন?
অতীতে বিভিন্ন সরকারের আমলে চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। এসব কাগুজে ঘোষণা দিয়ে লাভ কী, বাস্তবে যার কোনো প্রতিফলন নেই? যে বন্দর দিয়ে দেশের ৮০ শতাংশ পণ্য আমদানি–রপ্তানি হয়, সেই বন্দরের গুরুত্ব সরকারকে অনুধাবন করতে হবে। দেশের সুষম উন্নয়নের স্বার্থে চট্টগ্রামের শিল্পমালিকদের ন্যায্য দাবি মেনে নেওয়া হোক।