'হাম শেষ অনর পরে পুলিশ আইস্যি'

গতকাল সকাল ৮টা ৬ মিনিট। নন্দনকাননের অপর্ণাচরণ বালিকা উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্র। জনা পঞ্চাশেক মানুষের শান্ত উপস্থিতি। তখনো বুঝতে পারিনি অন্য রকম একটি দিন আমার জন্য অপেক্ষা করছে। ভোট সম্পর্কে আমার পূর্ব অভিজ্ঞতা যে আজকেই পুরোপুরি পাল্টে যাবে, তা ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারিনি।
ভোটের আগের দিনগুলোতে স্লোগান ও উৎসবমুখর নগর নিয়ে প্রতিবেদন লিখেছিলাম। নিজের ভোট দিয়ে প্রেসক্লাবের সামনে অপেক্ষমাণ গাড়িতে চেপে নগরের বিভিন্ন কেন্দ্র পরিদর্শনের জন্য যখন বের হই তখন সকাল ৯টা। আমরা গন্তব্য নগরের প্রান্ত। সমুদ্রনিকটবর্তী পতেঙ্গা। আমাদের মাইক্রো গাড়িটি যখন আগ্রাবাদ এসে পৌঁছায়, তখনই শুনলাম প্রথম খবর। আগ্রাবাদ টিঅ্যান্ডটি কলোনিতে কেন্দ্র দখল হয়েছে। দ্রুত আমাদের একজন প্রতিবেদককে ফোন করলাম সেখানকার পরিস্থিতি দেখতে।
আমাদের গাড়ি পতেঙ্গার উদ্দেশে চলতে লাগল। ৯টা ৫৫ মিনিটে পৌঁছালাম হাফেজ মোবারক আলী শাহ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার সুভাষ কান্তি দাশ জানালেন, পাঁচটি বুথে প্রথম এক ঘণ্টায় ১৬০টি ভোট গ্রহণ করতে পেরেছেন। স্কুলটির বারান্দায় ভোট দিতে আসা নারী-পুরুষের দীর্ঘ লাইন দেখে ভালো লাগল। নিপা আর মরিয়ম নামে দুজন ভোটার জানালেন, দেড় ঘণ্টা ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে ভোট দিতে পারছেন না। প্রিসাইডিং অফিসারকে জিজ্ঞেস করলাম বিলম্বের কারণ। তিনি বললেন, এক একজন ভোটারের জন্য তিনটি ব্যালট। তাই সময় নিচ্ছে। কেন্দ্রটির সুশৃঙ্খল পরিবেশ দেখে একটু আগে শোনা আগ্রাবাদের কেন্দ্রগুলো ব্যতিক্রম বলেই মনে হলো।
সকাল ১০টা ১২ মিনিটে পৌঁছে গেলাম পতেঙ্গা উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে। কেন্দ্রের সামনে অনেক তরুণের জটলা। বুকে তাদের ঝুলছে একজন মেয়র প্রার্থীর মার্কা। বিদ্যালয়ের গেট বন্ধ। আমরা বন্ধ গেট খুলে ভেতরে গেলাম। সেখানে সুনসান। কর্মকর্তারা বসে আছেন। ভোটার নেই। কী হলো। প্রিসাইডিং অফিসার দিদার হোসেনের কাছে গেলাম। তিনি থরথর কম্পিত অবস্থায় আমাদের কোনো কথার জবাব দিতে পারলেন না। এমনকি জানাতে পারলেন না তাঁর কেন্দ্রের ভোটারের সংখ্যা। দ্রুত বেরিয়ে এলাম। তখন জট পাকানো তরুণেরা স্লোগান দেওয়া শুরু করেছে একটি বিশেষ মার্কার নাম ধরে। কাছেই আলী হোসেন নামে এক ভোটারের সঙ্গে দেখা। তিনিও ভয়ে জড়োসড়ো। বললেন, ‘তিনটি ব্যালটে সিল মারলাম। বাক্সে ঢোকাতে যাচ্ছি এমন সময় ভাইয়েরা এসে খেদিয়ে দিল। সবাইকে তারা বের করে দিল।’ বললাম, আপনি ভোট দেননি? তিনি বললেন, ‘সিল মারছি। কিন্তু ব্যালট বাক্সে ঢোকাতে পারিনি। ভয়ে চলে আসছি।’ জিজ্ঞেস করলাম, তো আপনার ব্যালটগুলো কই? তিনি আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, এই যে আমার হাতে তিনটা ব্যালট। আলী হোসেনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমার সামনে হাজির হলেন ঘুড়ি মার্কার কাউন্সিলর প্রার্থী হারুনের একজন এজেন্ট। তিনি বললেন, আমাদের বের করে দেওয়া হয়েছে। তাদের সঙ্গে কথোপকথন চলছে। এমন সময় গাড়ি আওয়াজ শুনে পেছন ফিরে তাকালাম। দেখি পুলিশের গাড়ি এসে হাজির। পুলিশের গাড়ি দেখে লোকজনের মন্তব্য, ‘হাম শেষ অনর পরে পুলিশ আইস্যি (কাজ শেষ হওয়ার পর পুলিশ এসেছে)।’ এমন সময় আমার সঙ্গে থাকা আরেকজন সাংবাদিকের ফোন এল। তিনি জানলেন, একটু আগে যে স্কুলটিতে আমরা ভোটারদের দীর্ঘ লাইন দেখে পুলকিত হয়েছিলাম, সেটিতেও গন্ডগোল শুরু হয়ে গেছে। এভাবেই একের পর এক ফোন আসতে থাকে।
অনিয়ম, কেন্দ্র দখল, প্রতিপক্ষের এজেন্টের অনুপস্থিতি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা, ভয়ভীতি প্রদর্শন, ভোটকেন্দ্রের সামনে জটলা, মিছিল করে স্লোগান দিয়ে শোডাউন করে আতঙ্ক সৃষ্টি, কোথায় প্রকাশ্যে লাঠিসোঁটা নিয়ে ঘোরাঘুরি ইত্যাকার নানা অভিযোগ আসতে থাকে একের পর এক। তখনো দিনের বেশির ভাগ বাকি। মাত্র তিন ঘণ্টা অতিক্রান্ত হয়েছে।
বেলা ১১টায় শুনলাম, একজন মেয়র প্রার্থী মোহাম্মদ মনজুর আলম সংবাদ সম্মেলন ডেকেছেন। সোয়া ১১টার দিকে তিনি ঘোষণা দিলেন নির্বাচন বর্জনের। শুধু নির্বাচন নয়, রাজনীতিকেও তিনি বর্জন করবেন বলে আবেগ মথিত কণ্ঠে বললেন। এর কিছুক্ষণ পর সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক হাছান মাহমুদ বললেন, নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে বিএনপি এই অভিযোগ করেছে। প্রশ্নবিদ্ধ, এই শব্দটি বেশ কয়েকবার উচ্চারণ করলেন। মিনিট পনেরোর এই সংবাদ সম্মেলনের পর বাইরে এসে দেখি বাইরে উৎসব করছে সেই সব তরুণেরা। যারা সকাল থেকে নানা কাজে ব্যস্ত ছিল। মধ্যাহ্ণেই ওরা বিজয়ের স্লোগান দেওয়া শুরু করেছে।
ওমর কায়সার: সাংবাদিক।