সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছে, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ‘শিল্পকলা টিভি’ নামে একটি টিভি চ্যানেল চালু করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। দেশের শিল্প-সংস্কৃতি এবং বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির কার্যক্রম সারা দেশের মানুষের কাছে তুলে ধরতেই এই উদ্যোগ। এই চ্যানেলে সংগীত, নৃত্য, নাটক, চিত্রকলাসহ শিল্পের সব মাধ্যমের নানা অনুষ্ঠান দেখা যাবে।
অনেকের কাছে এই উদ্যোগ প্রশংসিত হবে। কিন্তু আমাদের মনে হয়, এটি গঠনমূলক চিন্তার ফল নয়। সংবাদপত্র থেকে জানা গেছে, মূল উদ্যোগটি ছিল শিল্পকলা একাডেমি কর্তৃপক্ষের। কতটা একপেশে ধারণা দ্বারা পরিচালিত হলে এ রকম চিন্তা হতে পারে, তা এই প্রস্তাব থেকে বোঝা যায়। এই প্রস্তাব যদি গৃহীত হতো, তাহলে কৃষিবিষয়ক, শিক্ষাবিষয়ক, মহিলা ও শিশুবিষয়ক নানা প্রতিষ্ঠান একটি করে টিভি চ্যানেল দাবি করে বসত। প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ, তিনি এই প্রস্তাব অনুমোদন করে অব্যবহৃত ‘সংসদ টিভি’ চ্যানেলকে শিল্প-সংস্কৃতির জন্য কাজে লাগাতে বলেছেন। অবশ্য এটিও খুব সুচিন্তিত মত নয়। কেন নয়, তা পরে বিস্তারিত লিখছি।
কয়েকটি ‘নিউজ চ্যানেল’ ছাড়া প্রায় ৩০টি টিভি চ্যানেল প্রতিদিন প্রায় কুড়ি ঘণ্টা সংগীত, নাটক, নৃত্য ইত্যাদি পরিবেশন করে থাকে। চিত্রকলা অবশ্য এখনো কোনো টিভি চ্যানেলের মনোযোগ আকর্ষণ করেনি। চিত্রকলা সম্পর্কে প্রচুর টিভি অনুষ্ঠান করার সুযোগও কম। তবে যতটুকু সুযোগ রয়েছে, তা-ও কোনো টিভি চ্যানেল ব্যবহার করেনি।
কিসের অভাব থেকে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ‘শিল্পকলা টিভি’ প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তা আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। সংগীত, নৃত্য ও নাটক আর কত দেখবে দর্শক? অবশ্য টিভিতে নাচের অনুষ্ঠান তুলনামূলকভাবে খুবই কম। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃপক্ষ বলতে পারে, আমরা উন্নতমানের মডেল অনুষ্ঠান দর্শকদের উপহার দেব। তাই প্রয়োজন ‘শিল্পকলা টিভি’। এটা একটা ভালো কারণ হতে পারে। এখানে একটা কথা বলা দরকার, এই টিভির কার্যক্রম মন্ত্রণালয় বাস্তবায়ন করবে না, করবে শিল্পকলা একাডেমি। আমরা মনে করি, এটা শিল্পকলা একাডেমির কাজ নয়। একাডেমি তার অ্যাজেন্ডামতো কাজ করবে। আমাদের আশঙ্কা, এই টিভি চালু হলে শিল্পকলা একাডেমির চলমান কাজের ক্ষতি হতে পারে। বর্তমানে শিল্পকলা একাডেমি প্রচুর কাজ করছে। এত কাজ কোনো সরকারের আমলে হয়নি। এ জন্য মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী সবার প্রশংসা দাবি করতে পারেন। যদিও কিছু কিছু কাজ নিয়ে সমালোচনার সুযোগ রয়েছে।
সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় যদি মনে করে বর্তমানে ৩০টি টিভি চ্যানেলে গান, নাটক বা নৃত্য নিয়ে উন্নতমানের অনুষ্ঠান হচ্ছে না, তাহলে তারা তথ্য মন্ত্রণালয়ের সহায়তা নিতে পারে। এ প্রসঙ্গে আমাদের প্রস্তাব: বিটিভি (সরকারি প্রতিষ্ঠান) যদি প্রতিদিন তিন থেকে চার ঘণ্টা সময় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে (সরকারের অংশ) ব্যবহার করতে দেয়, তাহলে শিল্পকলা একাডেমি বিটিভির স্টুডিও, কারিগরি সহায়তা, কারিগরি লোকবল, রিহার্সাল রুম সবই প্রায় বিনা পয়সায় পাবে। কারণ, বিটিভি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান নয়। দুটিই সরকারের অংশ। এই তিন-চার ঘণ্টা সময় কীভাবে ব্যবহার করবে, তা শিল্পকলা একাডেমি চিন্তা করবে। আমাদের মনে হয়, এভাবে শুরু করলে আমরা একটা ইতিবাচক ফল পেতে পারি। অথবা এমনও হতে পারে, এই তিন-চার ঘণ্টার অনুষ্ঠান দেখে দর্শক বলতে পারেন, ‘ওমা, এ রকম অনুষ্ঠান তো বিটিভিতেই দেখি। অন্যান্য চ্যানেলেও দেখি। শিল্পকলা একাডেমি নতুন কী করল?’ দর্শক কী বলবেন, অনুষ্ঠান প্রচারের আগে তা কেউ বলতে পারেন না। তবে তথ্য মন্ত্রণালয় যদি এই প্রস্তাবে রাজি হয়, তাহলে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে পৃথক একটি টিভি চ্যানেলের দায়িত্ব নেওয়ার প্রয়োজন হয় না। সরকারের টাকায়, সরকারের নীতিতে, সরকারের ব্যবস্থাপনায় একটি টিভি চ্যানেল (বিটিভি) কীভাবে পরিচালিত হয়, কী ধরনের অনুষ্ঠান হয়, তা তো আমরা প্রতিদিন দেখছি। আবার নতুন করে দেখার কী আছে? সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় বা শিল্পকলা একাডেমি তো অন্য কোনো সরকারকে প্রতিনিধিত্ব করে না। একই দলের সরকারের প্রতিনিধিত্ব করছে। খুব পৃথক বা ব্যতিক্রমী হওয়ার সুযোগ আছে কি?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ, তিনি নতুন কোনো সরকারি চ্যানেল তৈরি না করে বর্তমানে অব্যবহৃত ‘সংসদ চ্যানেল’কে কাজে লাগানোর নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু সেখানেও একটা সমস্যা রয়েছে। প্রায় ১০ বছর আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ‘এটুআই’ প্রকল্পের উদ্যোগে মিডিয়া ও শিক্ষা বিষয়ে একটি আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সংসদ চ্যানেলকে কীভাবে ‘শিক্ষা চ্যানেলে’ রূপ দেওয়া যায়, সে ব্যাপারে সেমিনারে অনেকে প্রস্তাব করেছিলেন। কীভাবে যেন আমিও সেই আলোচনায় আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। সভায় অন্যান্য শিক্ষা ও গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞসহ আমরা অনেকেই সংসদ চ্যানেলকে শিক্ষা চ্যানেলে পরিবর্তন করার জন্য প্রস্তাব করেছিলাম। (সংসদ অধিবেশনের সময়টুকু ছাড়া) তখন আমাদের মনে হয়েছিল, সরকারও এ রকমই চায়। কিন্তু সেমিনার শেষ হওয়ার পর অনেক দিন কেটে গেছে, এ ব্যাপারে কোনো কথা আর শোনা যায়নি। অনুমান করি, সরকারের ঘনিষ্ঠ কোনো শক্তিশালী মহল এই প্রস্তাব পছন্দ করেনি। হয়তো এ রকম হলে তাদের আর্থিক ক্ষতি হবে। প্রস্তাবটি আর এগোয়নি। আজ এত বছর পর সংসদ টিভির কথাটি যখন উঠেছে, তখন আমরা আবার দাবি তুলতে চাই, অব্যবহৃত সংসদ চ্যানেলকে ‘শিক্ষা চ্যানেলে’ রূপ দেওয়া হোক।
শিক্ষাবিষয়ক পরিকল্পিত নিয়মিত কোনো অনুষ্ঠান অন্যান্য টিভি চ্যানেলে প্রচারিত হয় না বললেই চলে। অথচ শিক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রাজধানী ঢাকাসহ বড় বড় শহরে কর্মরত অভিজ্ঞ, সফল ও জনপ্রিয় শিক্ষকদের রেকর্ডকৃত ক্লাস (স্কুল পর্যায়ে) ভিন্ন ভিন্ন সময়ে টিভির মাধ্যমে প্রচার করলে সারা দেশের ছাত্রছাত্রীরা উপকৃত হবে। এভাবে নিয়মিত পরীক্ষার সিলেবাস অনুসরণ করে দেশব্যাপী স্কুল পর্যায়ে উন্নতমানের মেধাবী ক্লাস পরিচালনা করা যায়। এভাবে প্রায় প্রতিটি পাঠ্যবই টিভি অনুষ্ঠানের মতো করে সারা দেশের ছাত্রছাত্রীদের কাছে পৌঁছানো সম্ভব। বছরের ৩৬৫ দিন টিভির মাধ্যমে যদি উন্নতমানের পাঠদান করা হয়, তাহলে দেশের স্কুলশিক্ষার্থীদের মান বাড়তে পারে। তাদের কোচিং-নির্ভরতা কমে যেতে পারে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রবণতা ও নির্ভরশীলতাও কমে যেতে পারে।
শুধু সিলেবাস-নির্ভর ক্লাস নয়, টিভির মাধ্যমে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের জন্য নানা রকম বিশেষ ক্লাস, বিশেষজ্ঞ বক্তৃতা, শিক্ষামূলক প্রামাণ্যচিত্র, প্রশ্ন ও উত্তর অনুষ্ঠান, ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণে বিভিন্ন রকম বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান, বার্ষিক সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতাসহ টিভির মাধ্যমে আরও কত কিছু করা যায়। অনেকে এসব জানেন। শুধু জানে না শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কারণ তাদের কর্মকর্তাদের মুখে কখনো এই দাবির কথা শুনিনি।
বর্তমানের বিভিন্ন প্রাইভেট টিভি চ্যানেলে শিক্ষা একেবারেই উপেক্ষিত। শিক্ষার মানোন্নয়নে এখনো আমরা টিভি মাধ্যমকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারিনি। আমাদের সরকার, শিক্ষানীতি প্রণেতাগণ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষাসচিব-কেউ বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে কোনো কথা বলেননি। অথচ তাঁরা শিক্ষা বিষয়ে প্রতি সপ্তাহে কয়েকটি বক্তৃতা দেন।
‘শিল্পকলা টিভি’র প্রস্তাবক, সমর্থক ও আগ্রহী ব্যক্তিরা আমাদের এই প্রস্তাবে যে অসন্তুষ্ট হবেন, তা আমরা জানি। আপনাদের জন্য আমাদের দুটি প্রস্তাব। ১) আপনারা বিটিভিকে উন্নত মানের শিল্প-সংস্কৃতির কাজে লাগানোর উদ্যোগ নিন। বিটিভি জনগণের টিভি। এটা কোনো সরকার বা দলীয় চ্যানেল নয়। এটা রাষ্ট্রের টিভি। বিভিন্ন সময়ের তথ্যমন্ত্রীরা বিটিভিকে ‘সরকারি টিভি’ বানিয়েছেন। এই ভুল ভাঙতে হবে। এ জন্য এখনই উপযুক্ত সময়। পৃথক টিভি চ্যানেলের ঝামেলায় না গিয়ে বিটিভি থেকে সময় চেয়ে নিন।
২) বাকি ৩০টি চ্যানেলের গান, নাটক, আবৃত্তি ও নৃত্যের অনুষ্ঠান মানোন্নয়নে শিল্পকলা একাডেমির বিশেষজ্ঞরা সহায়তা করতে পারেন। কারণ ৩০টি চ্যানেলে গান, নাটক ও নৃত্যের অনেক অনুষ্ঠান প্রত্যাশিত মানের নয়।
শিল্পকলা একাডেমি তাদের প্রস্তাবিত টিভি চ্যানেলে যা করতে চেয়েছে, সেই সব আইডিয়া অন্য ৩০টি চ্যানেলকে দিন। তারাও সেই সব অনুষ্ঠান করতে পারে। অন্য টিভি চ্যানেল তো রাত-দিন গান আর নাটক নিয়েই আছে।
সরকারের কাছে আবেদন, ‘সংসদ টিভি’কে অন্য কাজে ব্যবহার না করে শিক্ষার মানোন্নয়নে (প্রাইমারি থেকে উচ্চশিক্ষা) কাজে লাগান। এতে দেশ ও জাতি অনেক বেশি উপকৃত হবে।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর গণমাধ্যমকর্মী ও উন্নয়নকর্মী