‘ভয়ংকর রূপ আমরা সব সময় ধারণ করি না। কিন্তু নিজেদের এলাকায় আমাদের ওপর কেউ অন্যায় হস্তক্ষেপ করলে, প্রেমঘটিত কারণে কোনো গ্রুপের সঙ্গে দ্বন্দ্ব হলে কেবল সে ক্ষেত্রেই কাউকে আমরা টার্গেট করি। সোশ্যাল মিডিয়াকে আমরা চ্যালেঞ্জ দিয়ে থাকি। সময়ভেদে খুনখারাবি করতেও প্রস্তুত।’
একটি জাতীয় দৈনিকে ৫ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ঢাকার উত্তরার ক্যাসেল ভয়েস গ্রুপের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সদস্যের মন্তব্য ছিল এ রকম। প্রথম আলোর এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনেও দেখানো হয়েছে কিশোর অপরাধের ধরনে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। আগে চুরি-ছিনতাই বেশি করত, বর্তমানে তারা খুন-ধর্ষণের মতো অপরাধ বেশি করছে। প্রথম আলোর উপসম্পাদকীয় কলামে মশিউল আলম এই কিশোর-অপরাধীদের জন্য ‘কিশোর সংশোধনাগার’-এর অকার্যকারিতার কথা উল্লেখ করে ভিন্ন পন্থা বিবেচনার কথা বলেছেন। সাম্প্রতিক জঙ্গিবাদ, কিশোর গ্যাং, শিশু-কিশোরদের সহিংস আচরণ জাতিকে ভাবিয়ে তুলেছে। সময় এসেছে এর কারণ জেনে আশু প্রতিরোধব্যবস্থা গ্রহণের।
যেসব কিশোর অপরাধ করে, তাদের অপরাধের পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। অনেকে নানা ধরনের মানসিক ব্যাধিতে ভুগে থাকে। যেমন: ওডিডি (অপজিশনাল ডিফারেন্ট ডিসঅর্ডার) : এ ধরনের ডিসঅর্ডারে ভোগা কিশোরেরা অহেতুক তর্ক করে। এরা একরোখা ও প্রতিশোধপরায়ণ হয়। এরা উদ্ধত আচরণ করে এবং গুরুজনদের অমান্য ও অবজ্ঞা করে। সিডি (কনডাক্ট ডিসঅর্ডার) : এই ডিসঅর্ডারে ভোগা কিশোরেরা অন্যকে উত্ত্যক্ত করে; ভয় দেখায়; নিজ থেকে আক্রমণ করে, অনেক সময় অস্ত্র নিয়ে আক্রমণ করে; মানুষ ও প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করে, চুরি-ছিনতাই, ডাকাতি করে, ধর্ষণ-যৌন হয়রানি, আগুন লাগিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটায়। এ ছাড়া প্রতারণা, বিনা অনুমতিতে বাইরে রাত কাটানো, বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়া, মাদক গ্রহণ ও মেয়েদের পেছনে ঘোরাঘুরি করে থাকে।
জুভেনাইল ডেলিনকুয়েন্সি বা কিশোর অপরাধ হচ্ছে, ১৮ বছরের নিচের কিশোরদের এমন কাজ করা, যা প্রাপ্তবয়স্ক কেউ করলে ‘অপরাধ’ বলে গণ্য হতো ও শাস্তি পেত। মশিউল আলম লিখেছেন, এ বয়সসীমা কমিয়ে আনা যায় কি না। আমেরিকার বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে এ বয়সসীমা ১৭। তা ছাড়া, অপরাধের ভয়াবহতা ও ধরন দেখে কিশোর অপরাধীকে ও ক্ষেত্রবিশেষে প্রাপ্তবয়স্কদের মতো শাস্তির আওতায় আনার বিধান প্রায় সব দেশে রয়েছে।
কিশোর গ্যাং: পাশ্চাত্য সংস্কৃতি থেকে আমদানি করা এই অপসংস্কৃতির বিষয়টি আলোচনায় আসছে। এলাকার ওপর আধিপত্য (বনের পশুরা এই টেরিটোরিয়াল নিয়ম মেনে চলে) বজায় রাখতে, প্রেমঘটিত দ্বন্দ্ব বা ব্যক্তিবিশেষের দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে এরা মারামারি, খুনোখুনি সবই করে থাকে। এরা ‘মর্গ’ রুল মেনে চলে। যেখানে বলা হয়, মৃত্যুর আগে তুমি দল ত্যাগ করতে পারবে না, যদি করো অস্বাভাবিক হত্যার শিকার হবে, তোমাকে ‘মর্গে’ লাশ হয়ে যেতে হবে। কিশোর অপরাধীদের অনেকেই পরবর্তী সময়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। তবে এদের প্রায় ৬ শতাংশ বারবার অপরাধ করে এবং পরে দাগি অপরাধী হয়ে ওঠে। এই ৬ শতাংশ অপরাধীই ৭১ শতাংশ হত্যা-খুন ও ৬৯ শতাংশ মারাত্মক শারীরিক আঘাতের জন্য দায়ী।
কিশোর অপরাধের কারণ: কিশোর অপরাধের অনেক কার্যকারণের মধ্যে দুটি প্রধান কারণকে চিহ্নিত করা হয়—১. সন্তান লালনপালনে ত্রুটি এবং ২. সমস্যাগ্রস্ত সঙ্গীদের সঙ্গে মেলামেশা। অসামাজিক, অনৈতিক, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের হাতেখড়ি শুরু হয় সমাজবিচ্যুত, নষ্ট হয়ে যাওয়া বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশার কারণে।
সন্তান প্রতিপালনে ত্রুটি: ১. অতি প্রশ্রয়দানকারী প্রতিপালন পদ্ধতি বা পারসিমিভ স্টাইল: সবকিছুতেই অনুমতি দেওয়া, আচরণে নিয়মশৃঙ্খলা আরোপ না করা, অধিক প্রশ্রয় দেওয়া, সব ইচ্ছা পূরণ করা, অসংযমী আচরণে বাধা না দেওয়া এবং সঠিক আচরণ করার ব্যাপারে তাগিদ এবং ভালো কিছু করার জন্য চাপ না দেওয়া ইত্যাদি। ২. বশ্যতা স্বীকারে বাধ্যকরণ পদ্ধতি (অথোরিটারিয়ান স্টাইল) : সন্তানের ওপর বাবা-মায়ের একচেটিয়া কর্তৃত্ব, স্বৈরাচারী মনোভাব, সন্তান কোনো ভুল করলে তাকে নির্দয়-নিষ্ঠুর শাস্তি প্রদান, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ বা উপহাস করা, অন্যের সামনে হেয় করা, সার্বক্ষণিক সমালোচনা, অন্যের সঙ্গে তুলনা করা, পান থেকে চুন খসলেই চিৎকার-চেঁচামেচি ইত্যাদি। এ ছাড়া অনেক বাবা-মা সন্তানের সঙ্গে অবজ্ঞামূলক আচরণ করেন। তাঁরা সন্তানের ব্যাপারে উদাসীন থাকেন। সন্তানের ওপর তাঁদের কোনো নজরদারি থাকে না, সম্পৃক্ততা থাকে না। যেসব সন্তানের সঙ্গে এমন আচরণ করা হয়, তাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা দেখা দেয়।
দারিদ্র্য, মাদকাসক্তি, নিজেকে রক্ষা করার জন্য আশ্রয় গ্রহণ, পারিবারিক দ্বন্দ্ব, পরিবারে কেউ অপরাধী থাকা, প্রযুক্তির অপব্যবহার, সামাজিক অস্থিরতা, অপরাধের রাজনৈতিকীকরণ, সুষ্ঠু ও ন্যায়বিচারের অভাব।
প্রতিকার: কিশোর অপরাধের প্রতিকারে ‘কিশোর সংশোধনাগার’গুলো ব্যর্থ। এর কারণ সেখানকার পরিবেশ, প্রশিক্ষণ ও সেবার মান নিম্নমানের এবং আচরণ সংশোধনের কোনো উপাদান নেই। সংশোধনাগারগুলো নিছক একটি আটকখানা মাত্র। কিশোর অপরাধীদের ‘আটকে’ রাখা সহজ কাজ। কিন্তু তাদের চিন্তা-মনন-আচরণ-স্বভাবে মৌলিক পরিবর্তন আনা সহজ কাজ নয়। এর জন্য প্রয়োজন সৃজনশীল উদ্ভাবনী বিজ্ঞানসম্মত কার্যকর পদ্ধতি। শিশুদের প্রতিষ্ঠানে আটকে না রেখে নিজ পরিবারে ফিরিয়ে আনতে হবে, তাদের কাজ-আচরণের জন্য তাদের দায়বদ্ধ রাখতে হবে। অর্থাৎ সবাইকে তার মন্দ আচরণের জন্য জবাবদিহি করতে হবে। তারা যাতে সমাজের কল্যাণে অবদান রাখতে পারে সে রকম সুযোগ তৈরি করতে হবে, নতুন ও সমাজমুখী আচরণ শেখানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
আমাদের সমাজে আমরা দৃশ্যমান ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারছি? অপরাধীকে ‘অপরাধী’ হিসেবে গণ্য করে (রাজনৈতিকীকরণ না করা) দ্রুত গ্রেপ্তার, দ্রুত বিচার ও শাস্তি সমাজের কাছে দৃশ্যমান করতে প্রচার করতে হবে। অন্যদিকে শুধু শাস্তি দিলে হবে না, ভালো আচরণের জন্য সরাসরি পুরস্কারও দিতে হবে। দিতে হবে সম্মান ও মর্যাদা।
অন্যান্য প্রতিরোধ: ১. সঠিকভাবে সন্তান প্রতিপালনে মা-বাবাকে শিক্ষা প্রদান; ২. মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের সঠিক চিকিৎসা দেওয়া; ৩. সবার জন্য সুশিক্ষা নিশ্চিত করা; ৪. গ্যাং ও অন্যান্য খারাপ সঙ্গ থেকে শিশু-কিশোরদের দূরে রাখা; ৫. প্রযুক্তির অপব্যবহার রোধে পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয় নজরদারি থাকা; ৬. পারিবারিক, মানবিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের দিকে দৃষ্টি দেওয়া; ৭. সুস্থ সাংস্কৃতিক ও বিনোদনমূলক কার্যক্রম সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেওয়া; ৮. সৃজনশীল, উৎপাদনমুখী জ্ঞাননির্ভর কার্যক্রম গ্রহণ।
মনে রাখতে হবে, তারুণ্য হচ্ছে অফুরান ভালোবাসা, মমতা, সাহস, দেশপ্রেম দেখানোর সময়। তারুণ্যের এই সম্ভাবনার সর্বোত্তম ব্যবহার আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিজ্ঞা হবে, আমাদের সন্তানদের ‘রাখিব নিরাপদ—দেখাব আলোর পথ।’
মো. তাজুল ইসলাম: সোশ্যাল সাইকিয়াট্রিস্ট। অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, কমিউনিটি অ্যান্ড সোশ্যাল সাইকিয়াট্রি বিভাগ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা।