বয়স হয়ে গেছে, তাই সকাল-বিকেল হাঁটতে হয়। সামনেই গুলশান ইয়ুথ ক্লাবের বিরাট মাঠ। নানা দেশের নানা বয়সের ছেলেমেয়েরা সকাল থেকে হাঁটছেন। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ়-শ্রাবণ। আমিও উপস্থিত, কখনো বুড়োদের দলে, কখনো তরুণদের, কখনো–বা শিশুদের দলে। ক্লাবটি দেখছি ১০ বছর ধরে।
ক্লাবটির সবচেয়ে ভালো কাজটির কথা প্রথমে বলব। সেটি হলো গুলশান-সংলগ্ন শাহাজাদপুরের কম অবস্থাপন্ন ছেলেমেয়েদের তারা মাঠে খেলতে দেয়। তারা আসে বিভিন্ন গ্রুপে ভোর ছয়টা থেকে। কী তাদের উত্সাহ, কী তাদের উদ্দীপনা! কখনো ফুটবল, কখনো ক্রিকেট, কখনো ভলিবল খেলে তারা। প্রতিষ্ঠাতা রাফেজ আলম চৌধুরী শিশুর সারল্যে ক্লাবটিকে গড়ে তুলেছেন তিলে তিলে। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি তাঁর দিকে। প্রথম সাঁতার ক্লাব হলে নাতি-নাতনিদের নিয়ে গেলাম নতুন সুইমিং পুল দেখতে। প্রথম পানি বদলানো হলে আমারও ইচ্ছে করছিল সেখানে সাঁতার কাটি।
মনে পড়ে গেল বলরামপুর গ্রামের কথা। মা কিছুতেই সেখান থেকে আমাকে তুলতে পারতেন না। সারা দিন সাঁতার। মা বলতেন, ‘নাশতা খাবি না?’ বলতাম, না খাব না। দুপুরে এসে বলতেন, ‘ভাত খাবি না?’ বলতাম খাব। আজ কী রেঁধেছ? তিনি বলতেন, ‘তোর জন্য দুটি ইলিশ মাছের কোল রেখেছি।’ সঙ্গে সঙ্গে উঠে গেছি মায়ের সঙ্গে ভাত খেতে। যখন দেখি শহরের ছেলেমেয়েরাও সাঁতার কাটার সুযোগ পাচ্ছে, তখন ভাবি রাফেজের কথা এবং তাঁর সঙ্গে আরও এক শ জন, যাঁরা রাতদিন গুলশানের এই একটিমাত্র ক্লাবকে অন্য রকম উচ্চতায় নিয়ে যেতে সাহায্য করছেন।
আমি ক্লাবের সদস্য নই। কারণ, আমার অত টাকা নেই। মাঝেমধ্যে বড় গানের অনুষ্ঠান হয়। নামকরা শিল্পীদের গান শোনা যায়। বাড়ি পর্যন্ত গান ভেসে আসে। পয়সা দিয়ে টিকিট কিনি না। ক্লাবের সহসভাপতি হুমায়ুন কবির বলেছেন, ‘আব্বাসী ভাই, আপনার টিকিট লাগবে না।’ কিন্তু আমি যাই না। আমিও গায়ক। অন্যের গান পয়সা দিয়ে শুনতে যাব? তাই নিজেই গাইতে বসি ব্যালকনিতে। বকুল ডালের আগায় জ্যোৎস্না আমার গান শুনতে আসে। দু-তিন ঘণ্টাও একসঙ্গে গান গাই। স্ত্রী অবাক, ভাবে, বুড়ো বয়সে কাকে গান শোনাচ্ছে? ওপরের তলায় কোনো নতুন তরুণীকে নয় তো? আমি বলি, নিজকে শোনাচ্ছি। আমার গান গাইতে ভালো লাগে। তাই টেলিভিশনে আমাকে না ডাকলেও কিছু আসে যায় না। ইয়ুথ ক্লাবের সম্পাদক শওকত হোসেন জীবন, বাহরিন খান, সৈয়দা কবির, নিহার সিদ্দিকী আমাকে কয়েকবার অনুরোধ করেছেন নাতি-নাতনিদের পাঠাতে। বলেছেন, শরীরটাই আসল। না হলে বড় হতে পারব না। শাহাজাদপুরের ক্রিকেট ফ্যানদের ওরা জার্সি দিয়েছে, দিয়েছে ব্যাট ও বল। ওরা এম এস ধোনি হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। কেন দেখবে না? আমাদের দেশই শ্রেষ্ঠ ধোনিদের জন্ম দেবে। যাঁদের নাম বললাম, সারা দিন তাঁরা স্পোর্টসের পেছনে সময় দিচ্ছেন।
পয়লা বৈশাখ চলে গেছে, তাতে কী? দিনরাত রিহার্সাল জমেছে রবীন্দ্রনাথের আগমন নিয়ে। কী সুন্দর সুন্দর গান: ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে’। অন্য কোনো ক্লাব এমনটি করছে বলে শুনিনি। শুনতে পাচ্ছি, ‘দেখা দিক আর বার জন্মের শুভক্ষণ, হে চির নতুন’। কবির জন্মদিনে শত শত নারী সকাল থেকে উপস্থিত হবেন কবির প্রতি ভালোবাসা জানাতে। ছোট নাতি-নাতনিরা বাংলার পরিচয় পাচ্ছে এসব গানের মাধ্যমে। বৈশাখের পর যে জ্যৈষ্ঠ, তা তারা জানে। জ্যৈষ্ঠে আসছেন তারুণ্যের সম্রাট ঝাঁকড়া চুলের নজরুল। ১১ জ্যৈষ্ঠ আবার মেলা বসবে। সেদিন গাওয়া হবে ‘ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয় গান, আসি অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা দেবে কোন বলিদান’।
ক্লাবের সভাপতি ড. সিরাজুল ইসলাম কোনো দিন সংবাদপত্রে এগুলো ছাপানোর জন্য বিন্দুমাত্র ব্যবস্থা করেননি। কখনো বলেননি এগুলো টেলিভিশনে প্রচারিত হোক। ভাবলাম, তাঁদের কথা সবার জানা উচিত। কারণ, তাঁরা আগামী বাংলাদেশের সত্যিকারের স্বাপ্নিক। তাঁরা কাজ করে চলেছেন। তাঁদের স্বপ্ন নতুন বাংলাদেশ। তাঁরা রাজনীতির ধার ধারেন না। জানেন স্পোর্টস আর ‘উষার দুয়ারে হানি আঘাত আমরা আনিব নব প্রভাত, আমরা টুটাব তিমির রাত বাধার বিন্ধ্যাচল’।
প্রতিদিন সকাল-বিকেল ক্লাবের মাঠে হেঁটে আমি জীবনের রসদ সংগ্রহ করি। অনেক দিন বাঁচব বলে আশা। গুলশান ইয়ুথ ক্লাব আমাদের দিয়েছে নবযৌবন, দিয়েছে বাঁচার নতুন প্রেরণা। এই মাঠে আসুন এবং তরুণদের সঙ্গে একসঙ্গে পা ফেলুন।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সংগীত ব্যক্তিত্ব।
[email protected]