লজ্জার কথা যে বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে প্রথম আর বিশ্বের মধ্যে চতুর্থ। ইউনিসেফের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রতি তিনটি বিয়ের দুটিতেই কনের বিয়ের বয়স ১৮ বছর বা প্রাপ্ত বয়সের নিচে। মানে শিশু বয়সে বিয়ে, তারপর শিশু স্ত্রীর কোলে আরেক শিশুর আগমন। দুজনেরই স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। সারা জীবন রোগশোকে কাটাতে হয়।
এর সমাধান কোথায়? নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা, বখাটেদের উৎপাত, প্রলোভন দেখিয়ে নারী পাচার, নির্যাতন–জুলুমের বিরুদ্ধে যেমন দরকার আইনের কঠোর প্রয়োগ, তেমনি দরকার সামাজিক প্রতিরোধ। মেয়েদের নিরাপত্তা দিতে হবে। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্লিপ্ততা চলবে না। নারী নির্যাতন বন্ধে যাকে বলে ‘জিরো টলারেন্স’, তার বাস্তবায়ন অবশ্যই চাই।
এরপরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে। মেয়ে একটু বড় হলেই বাবা-মা মেয়ের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে বিয়ে দেওয়ার জন্য পাগল হয়ে ওঠেন। এই মনোভাব বদলাতে হবে। ২২ ডিসেম্বর ব্র্যাক ও প্রথম আলোর উদ্যোগে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে বিষয়টা খুব সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী। তিনি বলেন, ‘বিয়ে দেব’ কেন, কেন ‘বিয়ে করব’ নয়। আমাদের দেশে বাবা-মা বলেন, মেয়ের ‘বিয়ে দেব’, মেয়েরা কিন্তু ‘বিয়ে করব’ এই সম্মতিটুকু দেওয়ার সুযোগও পায় না। অথচ এটি তাদের অধিকার।
কখন কার সঙ্গে বিয়ে, সে বিষয়ে মা-বাবা, অভিভাবকের মতামত তো অবশ্যই থাকবে, কিন্তু মেয়ের সম্মতি এক নম্বরে স্থান পাবে। ১৮ বছরের আগেই মেয়ের আপত্তি সত্ত্বেও জোর করে কারও সঙ্গে বিয়ে দেওয়া যাবে না। যেদিন আমাদের বাবা-মায়েরা মেয়েদের ‘বিয়ে দেওয়ার’ প্রচলিত সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসবেন, মেয়েরা বলতে পারবে, কেউ ‘বিয়ে দেবে’ কেন, আমরা ‘বিয়ে করব’; সেদিন পরিস্থিতির গুণগত পরিবর্তন শুরু হবে। বাল্যবিবাহ বন্ধের ক্ষেত্রে ঘটে যাবে বিপ্লব।
আর একটু খুলে বলি। বাবা-মা ভাবছেন বখাটে ছেলেরা উত্ত্যক্ত করে, কবে উঠিয়ে নিয়ে যায়, মেয়েটার জীবন নষ্ট হয়ে যাবে। তার চেয়ে ভুয়া জন্ম সনদ নিয়ে বিয়ে ‘দিয়ে দিই’! সংসারের খরচ যেটুকু বাঁচবে, তা ছেলের পেছনে ব্যয় করে তাকে প্রতিষ্ঠিত করা যাবে। অথচ মেয়ে পড়াশোনা করছে। জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা দিল। চোখে তার স্বপ্ন—বড় হবে, বিদেশে লেখাপড়া করে স্বাবলম্বী হবে। সে কিন্তু বলতে পারছে না, এখন বিয়ে দিতে হবে না, সময় হলে, বয়স হলে, জীবনে কিছুটা প্রতিষ্ঠা পেলে ‘বিয়ে করব’। জোর দিয়ে এ রকম কথা বলার মতো আত্মবিশ্বাস তার নেই। এটা প্রতিষ্ঠা করতেই হবে।
বাল্যবিবাহ নিয়ে বিভ্রান্তি চলছে। সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে মেয়েদের ১৮ বছরের নিচে বিয়ে নয়। আবার মন্ত্রিপরিষদের সভায় মাঝেমধ্যে ‘কিন্তু, তবে, যদি’—এ রকম শর্ত আইনের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়ার কথাও উঠছে। যদি আইনে বিয়ের বয়স ১৮ রেখেও ‘বিশেষ পরিস্থিতিতে’ অভিভাবক, মা-বাবা অথবা আদালতের অনুমোদনে ১৬ বছরের সুযোগ রাখা হয়, তাহলে কেউ কি আর ১৮ বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করবে? ১৬ বছরই আইনসিদ্ধ হয়ে যাবে। সরকার ঠেকাবে কীভাবে?
বলা হচ্ছে, যদি বিয়ে হয়েই যায়, কী করা যাবে? এটা সমস্যা, সন্দেহ নেই। এই সমস্যা তো আগেও ছিল। আইন অনুযায়ী এ সমস্যার নিষ্পত্তিও হয়েছে অনেক ক্ষেত্রে। যদি সরকার কঠোর হয়, আর যদি সবাই বোঝেন বাল্যবিবাহ দিয়ে মেয়ে পার করতে গেলে কাঠগড়ায় যেতে হবে, কেউ পার পাবেন না, তাহলে ধীরে ধীরে সমস্যাগুলো কমে আসবে। একদিন দেশে বাল্যবিবাহ বলে কিছু থাকবে না।
আমরা নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলি। কিন্তু যদি বিয়ের ব্যাপারে মেয়ের ইচ্ছার দাম না থাকে, তাহলে কিসের ক্ষমতায়ন? এখনো এই আসল জায়গাতেই কিন্তু মেয়েরা অসহায়, ক্ষমতাহীন। এখানে পরিবর্তন আনতে হবে।
আমাদের দেশের মানুষ কখনো নারী-শিশুর বিরুদ্ধে সহিংসতা সমর্থন করে না। সিলেটে শিশু রাজন ও খুলনায় রাকিবকে নির্মম অত্যাচার করে মেরে ফেলার ঘটনায় অভাবনীয় জনরোষ সে কথাই বলে। ত্বরিতগতিতে বিচার ও সর্বোচ্চ শাস্তি দিয়ে বিচার বিভাগ, সরকার ও প্রশাসন উদাহরণ স্থাপন করেছে। নারীর বিরুদ্ধে সব ধরনের সহিংসতার বিরুদ্ধে যদি একই রকম উদাহরণ সৃষ্টি করা হয়, তাহলে গ্রামেগঞ্জে, পাড়ামহল্লায় বখাটে, গুন্ডা, বদমায়েশরা পালানোর পথ পাবে না। সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সহজ হবে। মেয়েরা আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবে।
ব্র্যাক কাজ করছে। কাজ করছে অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, স্বর্ণ কিশোরী নেটওয়ার্ক, ব্লাস্ট, মহিলা আইনজীবী সমিতি, ইউএনএফপিএ, ইউনিসেফ, ইউএন উইমেন। এ রকম শত শত বেসরকারি সংস্থার নাম উল্লেখ করা যায়। ওরা সারা দেশে নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তাদের চেষ্টায় প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যায়ে কমিউনিটি ওয়াচ গ্রুপ গড়ে উঠছে। প্রথম আলো ইউএন উইমেনের সঙ্গে ‘হি ফর শি ক্যাম্পেইনে’ (নারীর পক্ষে পুরুষ) কাজ করছে। ফলে পরিবর্তন আসছে। নারীর প্রতি সমাজে বিদ্যমান ত্রুটিপূর্ণ ও বৈরী দৃষ্টিভঙ্গি ধীরে ধীরে বদলে যাবে নিশ্চয়ই।
গত কয়েক মাসে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে প্রথম আলো অন্তত এক ডজন গোলটেবিল বৈঠক করেছে। নারী ও শিশু নির্যাতন রোধ, বাল্যবিবাহ বন্ধ, নারীর প্রজনন স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিশেষজ্ঞরা আলোচনা করেছেন। সুপারিশগুলো তুলে ধরেছেন।
ইউএনএফপিএর সহযোগিতায় প্রথম আলো প্রতি মাসে ‘আমাদের কথা শোনো’ নামে ক্রোড়পত্র বের করছে। সেখানে কিশোর-কিশোরী-তরুণদের কথা আমরা ছাপাচ্ছি।
সরকারও কাজ করছে। আমাদের গোলটেবিল বৈঠকে কেরানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবুল বাশার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বললেন, তাঁরা বাল্যবিবাহ বন্ধে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছেন। খবর পেলেই বাল্যবিবাহ রোধে কঠোর পদক্ষেপ নেন। তাঁদের উপজেলায় নিয়মিত মা-সমাবেশ করেন। এতে মা ও মেয়েদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস দৃঢ়তর হয়।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি তো আমাদের এক গোলটেবিল বৈঠকে বেশ জোর দিয়েই বললেন, মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ বছরই থাকবে, কোনো তবে-টবে থাকবে না। এ রকম দৃঢ় অবস্থান আমাদের আশান্বিত করে। নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টি সেক্টোরাল প্রকল্প মহিলা অধিদপ্তরের আওতায় কাজ করছে। তাদের একটি টোল ফ্রি হেল্পলাইন রয়েছে। আপদে-বিপদে যে কেউ একদম বিনা পয়সায় ১০৯২১ নম্বরে ফোন করলেই সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকশন! ২৪ ঘণ্টা ৩০টি লাইন চলছে। আরও আছে। ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার, নির্যাতিত নারীদের জন্য সেইফ হোম। তাদের বিনা পয়সায় সরকারি আইন সহায়তা ব্যবস্থা। আরও কত কী।
ব্যারিস্টার সারাহ হোসেন জানালেন, বিয়ের বিষয়ে সম্মতি মেয়েদের মৌলিক অধিকার। এ বিষয়ে আদালতের একটি খুব শক্তিশালী রায় আছে। কোনো মেয়েকে বাল্যবিবাহে বাধ্য করা যাবে না।
সংবিধানে অন্তত তিন-চারটি অনুচ্ছেদে নারীর অধিকার সুরক্ষার কথা আছে। অন্তত ছয়টি শক্তিশালী আইন দেশে আছে। এখন দরকার এগুলোর কার্যকর প্রয়োগ। সরকার বিভিন্ন এনজিওর সঙ্গে একত্রে কাজ করছে। আরও দরকার। এসব এনজিওকে একেবারে বিনা বাক্যব্যয়ে কাজ করতে দিলে বাল্যবিবাহ রোধসহ নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতার বিরুদ্ধে জনসচেতনতা বৃদ্ধি সহজ হবে।
একটি সমাজ কতটা আধুনিক, তা বোঝার অন্যতম শর্ত হলো সেই সমাজে নারীর অবস্থান কতটা উন্নত তা দেখা। যদি নারীর সম–অধিকার থাকে, মর্যাদা নিশ্চিত হয়, ১৮ বছরের আগে বিয়ে বন্ধ করা যায়। যদি তাদের শিক্ষার দ্বার অবারিত হয়। যদি শুধু বাইরে না, ঘরেও সিদ্ধান্ত গ্রহণে পুরুষের সমান অধিকার নারীর থাকে, তাহলে সত্যিকারভাবেই সেই সমাজ আধুনিক। সভ্য। আমরা এখনো সেই ‘আধুনিক ও সভ্য’ অবস্থানের সনদ প্রাপ্তি থেকে বেশ দূরে আছি।
কিন্তু এ রকম তো হওয়ার কথা নয়। আমাদের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে জাতীয় সংসদের স্পিকার, বিরোধী নেত্রী, নির্বাচিত মেয়র ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ স্তরে অনেক পদেই রয়েছেন নারী। আনুষ্ঠানিক ক্ষমতায়ন হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সমাজটা এখনো চলছে পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে।
এখানে পরিবর্তন আনতে হবে। নারী-পুরুষ সবাইকে এক হয়ে দাঁড়াতে হবে।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
[email protected]