'নির্বাচন' প্রতিযোগিতার নিয়মটা অন্তত মানা হোক
মুখভর্তি দাড়ি, পরনে সবুজ হাফপ্যান্ট ও লাল স্যান্ডো গেঞ্জি। স্পোর্টস শু পায়ে ট্র্যাকে দৌড়াচ্ছেন সাচা ব্যারন কোহেন। রয়েছে আরও বেশ কয়েকজন প্রতিযোগী। তারা দৌড়াচ্ছে তাঁর পিছু পিছু। কিন্তু কোহেনকে কেউ অতিক্রম করছে না; বলা ভালো অতিক্রমের চেষ্টাই করছে না কেউ। কারণ স্বভাবগতভাবে একজন একটু জোরে দৌড়ানোয় কোহেনের হাতে থাকা রিভলবার থেকে গুলি ছুটে গেছে তার দিকে।
হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন, কোহেন দৌড়াচ্ছিলেন অস্ত্র হাতেই। তাঁর বিজয়ী হওয়ার পথে এটিই ছিল সবচেয়ে বড় শক্তি। সবচেয়ে বড় বলা হচ্ছে, কারণ এটিই একমাত্র নয়। একমাত্র যে নয়, তা বোঝা গেল দৌড় প্রতিযোগিতার শেষ দিকে, যেখানে ফিতাটিই এগিয়ে আসে তাঁকে বিজয়ী করতে। এমন অসাধারণ কৌতুকপূর্ণ ও দারুণ ইঙ্গিতবহ দৃশ্যের দেখা মিলেছে ২০১২ সালে নির্মিত বিখ্যাত চলচ্চিত্র দ্য ডিক্টেটর-এ। ল্যারি চার্লস পরিচালিত এই পলিটিক্যাল স্যাটায়ারের মুখ্য চরিত্র অ্যাডমিরাল জেনারেল আলাদিন চরিত্রটি রূপায়ণ করেছিলেন সাচা ব্যারন কোহেন। এই চলচ্চিত্রেরই একটি দৃশ্যে এ দারুণ দৌড় প্রতিযোগিতার দেখা মেলে, যেখানে প্রতিযোগিতার বিধিবদ্ধ নিয়মের কোনো বালাই ছিল না। পুরো প্রতিযোগিতাই ছিল অ্যাডমিরাল জেনারেল আলাদিনের একটি খেয়াল, যার আয়োজন হয়েছিল শুধু এটি প্রমাণ করতেই যে দৌড়ে আলাদিনই সেরা।
কথা হচ্ছে এমন নির্বাচনী মৌসুমে কেন আলাদিনকে নিয়ে টানাটানি? উত্তর হচ্ছে, নির্বাচনও তো একটি প্রতিযোগিতাই। একটি নির্দিষ্ট মেয়াদে দেশ পরিচালনার জন্য জনগণের সম্মতি আদায়ের প্রতিযোগিতা নির্বাচন। প্রতিযোগিতা মানেই এখানে কিছু নিয়ম থাকবে। কথা হলো তাহলে কিংবদন্তি উসাইন বোল্টের যেকোনো একটি দৌড় প্রতিযোগিতার উদাহরণ না এনে এই কাল্পনিক চরিত্র আলাদিনের দৌড় নিয়ে কেন ঘাঁটাঘাঁটি? কারণটি একটু খুঁজলেই পাওয়া যাবে। চলতি বছর ঘটমান ও ঘটে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন নির্বাচনের ফল এবং এর ধরনের দিকে তাকালে আলাদিনকেই শুধু দৌড়াতে দেখা যাবে। সবুজ হাফপ্যান্ট ও লাল স্যান্ডো গেঞ্জি পরে হাতে অস্ত্র নিয়ে দৌড়তে থাকা আলাদিনের সঙ্গে কী দারুণ মিল এ বছর দেশে দেশে হওয়া নির্বাচনগুলোর!
একটু উদাহরণ দেওয়া যাক। গত মার্চে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কে জিতবে, তা আগে থেকেই সবাই জানত। যদি কিছু অপেক্ষা থেকে থাকে, তবে তা ছিল কত ব্যবধানে ভ্লাদিমির পুতিনের জয় হবে, তা নিয়ে। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীকে জেলে পুরে, অন্যদের প্রচারে বাধা সৃষ্টি করে এবং রাষ্ট্রের সব শক্তিকে ব্যবহার করে পুতিন তাঁর জয় বুঝে নিয়েছেন। প্রকল্পিত এ জয় বুঝে নেওয়ার পথে আদালত, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যম থেকে শুরু করে সবকিছুকে ব্যবহার করেছেন নিজের মতো করে। শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীকে ট্র্যাক-আউট করতে আলাদিনের মতোই প্রতিযোগিতার নিয়ম ভেঙেছেন নিজের মতো করে।
একই পন্থা অবলম্বন করেছেন তুরস্কের বর্তমান প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। তুরস্কের সাধারণ ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল ২০১৯ সালের নভেম্বরে। কিন্তু তা এক বছর এগিয়ে এনে এ বছরের ২৪ জুন একই সঙ্গে দুটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করা হয়। এর আগেই তুরস্কের আইনে পরিবর্তন এনে প্রেসিডেন্টের হাতে তুলে দেওয়া হয় বিপুল ক্ষমতা। এই ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে এরদোয়ান তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীদের হটান নানা রেসিপি অনুসরণ করে। আদালতের মাধ্যমে দণ্ড ঘোষণা, জোরপূর্বক নির্বাসনসহ নানা পন্থায় পুতিনের মতো করেই ট্র্যাক-আউট করেন তিনি নিজের প্রতিদ্বন্দ্বীদের। তারপর আলাদিনের মতো করেই ভোটের ফিতাটিও এগিয়ে এনে নির্ধারিত সময়ের বহু আগেই নিজেকে প্রেসিডেন্টের পদে অধিষ্ঠিত করেন।
তাকানো যেতে পারে ব্রাজিলের নির্বাচনের দিকে। টানা অস্থিরতার মধ্যে থাকা ব্রাজিলের নির্বাচনের দিকে মনোযোগ ছিল সবারই। সেখানে লোকরঞ্জনবাদিতার পথে বিজয় হয়েছে জায়ের বোলসোনারোর, যাঁকে বলা হয় ব্রাজিলের ডোনাল্ড ট্রাম্প। কট্টর এই রাজনীতিকের বিজয়ে আন্তর্জাতিক মহল ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। কারণ, তিনি ট্রাম্পের পথে হাঁটলে ব্রাজিলের ভবিষ্যৎ কট্টর একনায়কের হাতে আটকা পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। নির্বাচনে বিজয়ের পথে তিনি নিজ শিবিরে ভিড়িয়েছেন সামরিক বাহিনীকে। অর্থাৎ নির্বাচনী দৌড়ে জিততে আলাদিনের মতো গুলি না ছুড়লেও অস্ত্রটি ঠিকই দেখিয়েছেন বোলসোনারো।
আসা যাক কম্বোডিয়ায়। গত ২৯ জুলাই অনুষ্ঠিত নির্বাচনে কম্বোডিয়া কোনো নতুন শাসক পায়নি। কম্বোডিয়ান পিপলস পার্টির নেতা হুন সেনই বসেছেন প্রধানমন্ত্রীর আসনে। তাঁরই অবশ্য বসার কথা। কারণ, প্রধান বিরোধী দলকে আদালতের মাধ্যমে নিষিদ্ধ করে রাস্তাটি আগেই পরিষ্কার করেছিলেন তিনি। নির্বাচনটি অবশ্য অংশগ্রহণমূলকই ছিল। প্রধান বিরোধী পক্ষ কম্বোডিয়া ন্যাশনাল রেসকিউ পার্টি (সিএনআরপি) না থাকলেও নির্বাচনে ছিল ২০টি দলের অংশগ্রহণ। ফলে একে প্রতিযোগিতা না বলার কোনো উপায়ই নেই; হোক না আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। একই কথা বলা যায় ২০ মে অনুষ্ঠিত ভেনেজুয়েলার নির্বাচন নিয়েও। তুরস্কের মতোই এই নির্বাচনও নির্ধারিত সময়ের আগেই অনুষ্ঠিত হয়। আর সেই নির্বাচনে অবধারিতভাবেই বিজয়ী হন নিকোলাস মাদুরো। এর অন্যথা হওয়ার কোনো সুযোগই ছিল না। আন্তর্জাতিক মহল থেকে শুরু করে বিরোধী পক্ষ, সবাই নির্বাচনের ধরন নিয়ে প্রশ্ন তুললেও তা কানেই তোলেননি মাদুরো।
এখানে আরও অজস্র উদাহরণ টানা যায়। তবে শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের নির্বাচন এবং তার পরবর্তী ঘটনাগুলোর দিকেও তাকাতে হয়। শ্রীলঙ্কায় যেমন মাহিন্দা রাজাপক্ষেকে ক্ষমতায় বসাতে গিয়ে প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা ফিতা নিয়ে ছুটে আসতে গিয়ে রীতিমতো সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি করেছেন। আবার হাজারটা ঘুঁটি সাজিয়েও, প্রশাসনিক ও দলীয় সব শক্তি প্রয়োগ করেও মালদ্বীপে আবদুল্লাহ ইয়ামিনের জিততে না পারার উদাহরণও সামনে আছে। অবশ্য এই দুই ক্ষেত্রেই চীন ও ভারতের মতো শক্তির মধ্যে চলা নানা সমীকরণ রয়েছে।
বর্তমান বিশ্বগ্রামে কোনো দেশ বিচ্ছিন্ন নয়। ফলে শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের মতো অনেক ছোট দেশের পক্ষেই বড় ক্ষমতাধর দেশের প্রভাব এড়ানো সম্ভব হয় না। শুধু ছোট দেশ কেন, ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রুশ হস্তক্ষেপের অভিযোগ নিয়ে যখন তদন্ত চলে, তখন এমন প্রভাবের বাইরে তো কেউই থাকার কথা নয়। ফলে নির্বাচনে নানামাত্রিক সমীকরণ থাকবে—এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তা তখনই প্রশ্নের জন্ম দেয়, যখন তা একেবারে দৃষ্টিকটুভাবে সামনে আসে। তখন এটি অনেকটা ওই অ্যাডমিরাল জেনারেল আলাদিনের মতো অস্ত্র হাতে প্রকল্পিত ছকে দৌড়ানোর মতো দৃশ্য তৈরি করে। দুঃখের হলেও সত্য এই যে এ বছর সারা বিশ্বে হওয়া বিভিন্ন নির্বাচনে এমন প্রতিযোগিতাই দৃশ্যমান হয়েছে, যেখানে প্রতিযোগিতার কোনো শর্তই মানা হয়নি।
কথা হচ্ছে শর্তই যদি মানা না হয়, তবে প্রতিযোগিতা আয়োজনের দরকার হয় কেন। ওই যে বিশ্বগ্রাম। সেখানে নানা সমীকরণ থাকে। এই সমীকরণের কারণেই আইনের শাসন ও সাধারণ মানুষের মতপ্রকাশের অধিকার অক্ষুণ্ন রয়েছে এমন কিছু প্রদর্শনের প্রয়োজন হয়। আর ধুঁকতে থাকা গণতন্ত্রের দেশে একটি নির্বাচন আয়োজনই একমাত্র এই প্রদর্শন নিশ্চিত করতে পারে। এই আয়োজন করা হয় এটা বলতে যে, ‘আমি জেঁকে বসিনি, আমাকে বসিয়েছে জনগণ।’ আর এই বলতে গিয়ে অ্যাডমিরাল জেনারেল আলাদিনের মতো কত কী-ই না করছে দেশে দেশে শাসকেরা। বাংলাদেশের দরজায়ও একটি নির্বাচন দাঁড়িয়ে। একটি রেসে নামার টিকিট কেটে ট্র্যাকে দাঁড়িয়ে আছেন প্রার্থীরা। এই দৌড়ে প্রতিযোগিতার নিয়মটি মানা হোক—এটাই প্রত্যাশা।
ফজলুল কবির: সহসম্পাদক, প্রথম আলো