ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার পরে হোক কিংবা হোক তার আগে, পৌরসভা নির্বাচন আসন্ন। ইতিমধ্যে মাঠে হাওয়াও বইতে শুরু করেছে বেশ জোরেশোরে। নানা কারণে শিগগির এই হাওয়া যে ঝোড়ো রূপ নেবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
বাংলাদেশে এই প্রথম দলীয় পরিচয় ও প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হতে যাচ্ছে। ১২ অক্টোবর মন্ত্রিসভা বিষয়টি অনুমোদন করে। পৌরসভা নির্বাচন করতে হবে ডিসেম্বরের মধ্যে, আর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হওয়ার কথা মার্চে। হাতে সময় কম থাকায় পৌরসভা নির্বাচন আইনটি অধ্যাদেশ আকারে জারি হয়েছে। নির্বাচন কমিশন মেয়াদ শেষ হওয়া ২৪৫টি পৌরসভার নির্বাচন চলতি বছর ডিসেম্বরের মধ্যেই শেষ করতে চায়।
এই প্রথম দলীয় পরিচয়ে ও প্রতীকে স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন হতে যাচ্ছে। আইনকানুন ও প্রক্রিয়াগত পরিবর্তনের ফলে এই নির্বাচনে কিছু বাড়তি মাত্রা যুক্ত হলেও ভোটারদের অভিজ্ঞতায় তা বড় কোনো ধাক্কা দেবে না বলেই মনে হয়। কেননা, সাম্প্রতিক সময়ে এই স্থানীয় সরকার নির্বাচনও দলীয় রূপে হাজির হয়েছে এবং ভোটাররা এতে অনেকটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। তবে বাড়তি চাপ পড়বে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর। নির্বাচনের গায়ে আনুষ্ঠানিক দলীয় লেবেল থাকায় এর ঘটন-অঘটন এবং জয়-পরাজয়ের দায় নিতে হবে সরাসরি রাজনৈতিক দলগুলোকেই। হেরে গেলে ‘এ তো স্থানীয় সরকার নির্বাচন, এখানে দলের প্রতীক নেই’, এসব বলে আর পার পাওয়া যাবে না। নির্বাচনে কারচুপি হলে সে ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে একই কথা। নতুন এই ব্যবস্থায় নির্বাচন কমিশনকেও সামাল দিতে হবে বাড়তি ঝক্কি। অবশ্য সব মিলিয়ে কথার মারপ্যাঁচে রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা এ ব্যবস্থায় কমে আসবে এবং দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রচর্চার সুযোগ সৃষ্টি হবে। অবশ্য দলগুলো যদি এ ব্যাপারে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়।
বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আসন্ন পৌরসভা নির্বাচন দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল তথা জোটের জন্য বেশ কটি বড় চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসছে। ক্ষমতাসীন দল ও জোট অনেকটা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকলেও তাদের চ্যালেঞ্জগুলো একেবারে ফেলনা হবে বলে মনে হয় না।
১৪ দল, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হলো নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়ন। প্রার্থী মনোনয়নের চূড়ান্ত ক্ষমতা দলের কোন পর্যায়ের হাতে থাকবে, সেটাও বড় প্রশ্ন। এ ক্ষেত্রে পুরোনো খেলার পুনরাবৃত্তি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। অর্থাৎ যে স্থানে যেসব মন্ত্রী, সাংসদ বা কেন্দ্রীয় নেতার প্রভাব বেশি, সেসব স্থানে তাঁদের পছন্দের প্রার্থীরাই মনোনয়ন পাবেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় ও দলটি দ্বিতীয় মেয়াদে গদিনিশন হওয়ায় দলের অভ্যন্তরে নানা স্বার্থের টানাপোড়েন এবং একে কেন্দ্র করে উপদলীয় কোন্দল ব্যাপকভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। দলে ত্যাগীরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এখন প্রায় পর্যুদস্ত। সামনে চলে এসেছে স্বার্থলোভী ও মোসাহেবেরা, দুর্দিনে যাদের কেউ মাঠে দেখেনি। কোথাও কোথাও অন্য দল, এমনকি বিএনপি-জামায়াতের লোকেরাও দলে শামিল হয়েছে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এরা প্রধানত মন্ত্রী-সাংসদ-প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কাছে বেশি প্রিয়ভাজন হওয়ার কারণেই সৃষ্টি হয়েছে এ অবস্থা, যা মনোনয়নের ক্ষেত্রে পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলতে পারে। এবং এই জটিলতা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে নির্বাচনের ফলাফলের ওপর সরাসরি এর প্রভাব পড়বে বলেই মনে হয়।
>দেশের বড় দলগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রচর্চায় অনীহা থাকায় এবং ভোগ-লোভ-দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন ইত্যাদি রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রধান অঙ্গ হয়ে ওঠায় ইদানীং নির্বাচনী মাঠে একটা পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। সাধারণের মধ্যে উৎসাহ কমে যাচ্ছে নির্বাচনের প্রতি। ভোটারদের এই নেতিবাচক মনোভাবের চাপটা কিন্তু ক্ষমতাসীনদের গায়েই বেশি লাগার সম্ভাবনা
নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত না হলে তার দায়ও গিয়ে পড়বে ক্ষমতাসীন দলের ওপর। এ ক্ষেত্রে বিরোধী দলগুলোর হাতে ‘ইস্যুহীন মাঠে’ একটি মোক্ষম ইস্যু তুলে দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। এত দিনের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা অনেক বেশি সক্রিয় থাকায় সাধারণভাবে এতে বড় কোনো অঘটন ঘটে না। এ রকম অবস্থায় ২৪৫টি পৌরসভার অধিকাংশ মেয়র পদে যদি ক্ষমতাসীন দল বা জোট জয়ী না হয়, তাহলে বর্তমান ক্ষমতাসীনদের সরকারে থাকার বিষয়টি নৈতিক দিক থেকে প্রশ্নবিদ্ধ হবে। বিএনপি-জামায়াত জোটের মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবির বিষয়টি যৌক্তিক হয়ে সামনে চলে আসবে। এ ক্ষেত্রে দলীয় পরিচয়ে ও প্রতীকে নির্বাচন হওয়ায় বিরোধীদের যুক্তি খণ্ডন করা কঠিন হয়ে পড়বে। এমনকি আন্তর্জাতিক মহলের চাপও বাড়বে ক্ষমতাসীনদের ওপর।
আসন্ন পৌরসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সবচেয়ে নাজুক অবস্থানে আছে বিএনপি-জামায়াত জোট। বড় দল হিসেবে বিএনপি এখন ‘নির্বাচনে গেলেও বিপদ, না গেলেও বিপদ’, এমন একটা দুধারি তলোয়ারের নিচে ঘাড় পেতে দিয়েছে। এখনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না দিলেও গত বছরের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ভুল তারা এবার করবে না বলেই মনে হয়। মাঠপর্যায়ে তাদের নেতা-কর্মীদের প্রস্তুতির খবরও পাওয়া যাচ্ছে।
বিএনপি কীভাবে নির্বাচন করবে, এ প্রশ্নের কোনো জুতসই উত্তর কর্মী দূরে থাক, তাঁদের নেতাদের কাছ থেকেই কিন্তু মিলছে না। বিরাট সমর্থক গোষ্ঠী থাকা সত্ত্বেও সাংগঠনিক বিবেচনায় বিএনপির অস্তিত্ব নিয়েই এখন প্রশ্ন তোলা যায়। দল গোছানোর কথা বলে বিএনপির সিদ্ধান্ত প্রদানকারী শীর্ষ নেতৃত্ব এখন দেশের বাইরে। হেফাজতে ইসলামের ঢাকায় অবস্থানের ঘটনা থেকে শুরু করে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে বারবার আহ্বান সত্ত্বেও কর্মীদের মাঠে নামাতে না পারা, সহিংস অবস্থান নিয়েও ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহত করতে ব্যর্থ হওয়া, আন্দোলনের নামে চলতি বছরের গোড়ায় লাগাতার তিন মাস অগ্নিসন্ত্রাসের দায় নিয়ে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া, নেতা-কর্মীদের ব্যাপক হারে মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে পড়া এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও জামায়াত প্রশ্নে সুস্পষ্ট অবস্থান নিতে না পারায় এমনিতেই দলটির অবস্থা বিপর্যয়ের মুখে। এখন আবার এর সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে দুই বিদেশি নাগরিক হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ এবং দলের ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরীর সাম্প্রতিক পদত্যাগকে কেন্দ্র করে নানা গুঞ্জনের ধাক্কা।
দলের ইতিহাসে এসব হ্যাপার মধ্যে থেকে কেবল সমর্থক গোষ্ঠীর কল্যাণে দলটি নির্বাচনে কত দূর কী করতে পারবে, সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ থেকে যাচ্ছে। এ ছাড়া নির্বাচনে অংশ নিলে দলটিকে আরও কিছু প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। প্রথমত, দলীয় ব্যানারে নির্বাচন হওয়ায়, ‘এই অবৈধ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন নয়’, এমন নৈতিক অবস্থান থেকে সরে আসার যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা বিএনপিকে দাঁড় করাতে হবে। দ্বিতীয়ত, নিবন্ধিত দল না হওয়ায় এই নির্বাচনে জামায়াতের অংশ নেওয়ার সুযোগ নেই। সাম্প্রতিক সময়ে অনেকটা জামায়াতনির্ভর বিএনপি তাই জামায়াত প্রশ্নে কতটা সফল কৌশল গ্রহণ করতে পারে, তার ওপর নির্ভর করবে এই নির্বাচনে তাদের জয়-পরাজয়। তৃতীয়ত, দলটি নির্বাচনে অংশ নিয়ে ফলাফলের ক্ষেত্রে সম্মানজনক অবস্থান ধরে রাখতে না পারলে দীর্ঘমেয়াদি বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বে।
এই নির্বাচনে সবচেয়ে বড় প্রভাব বিস্তারকারী উপাদান হয়ে উঠতে পারে ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে ওঠা নতুন একটি বিষয়। দেশের বড় দলগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রচর্চায় অনীহা থাকায় এবং ভোগ-লোভ-দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন ইত্যাদি রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রধান অঙ্গ হয়ে ওঠায় ইদানীং নির্বাচনী মাঠে একটা পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। সাধারণের মধ্যে উৎসাহ কমে যাচ্ছে নির্বাচনের প্রতি। ভোটারদের এই নেতিবাচক মনোভাবের চাপটা কিন্তু ক্ষমতাসীনদের গায়েই বেশি লাগার সম্ভাবনা। কাজেই নির্বাচন সুষ্ঠু হলে ‘তোমাকে হারানোর জন্য তাকে জেতাব’, ভোটারদের এই মানসিকতা আসন্ন পৌরসভা নির্বাচনেও কাজ করতে পারে। বিগত সময়ে রাজশাহী, রংপুর, সিলেট, খুলনা ও গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এ প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। মানুষ রাজনীতিবিমুখ ও নির্বাচনের ব্যাপারে বীতশ্রদ্ধ হলেই এমনটা ঘটে থাকে। এত দিন একই দলের বঞ্চিত ও হতাশ নেতা-কর্মীদের মধ্যে এই প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। কিন্তু এখন অনেক সাধারণ ভোটারও এই দলভুক্ত হচ্ছে এবং তাঁদের আপাত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে নির্বাচনে নেতিবাচক ভোট প্রদানের মাধ্যমে। কেবল দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রচর্চা ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তনই এ অবস্থার অবসান ঘটাতে পারে। না হলে ‘তোমাকে হারানোর জন্য তাকে জেতাব’, এটাই হয়তো ভবিষ্যতে হয়ে উঠবে আমাদের রাজনীতির ‘নয়া ডিসকোর্স’।
মলয় ভৌমিক: অধ্যাপক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, নাট্যকার।