'জঙ্গিবাদ' ও 'স্যাড জেনারেশন'
তরুণদের ভাবনা নিয়ে প্রথম আলোর জরিপ ২০১৭ বলছে, দেশের ৮২ শতাংশ তরুণ তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। ‘জীবনের লক্ষ্য কী জানে না’ এমন তরুণের সংখ্যা ৬৩ শতাংশ; শতকরা ৭৩ ভাগ তরুণ চিন্তিত ‘পরিবার থেকে বিচ্ছিন্নতা নিয়ে’। তরুণদের পড়ার সময় খেয়ে ফেলছে ইন্টারনেট; তাদের ভেতরে অসন্তোষ আছে, ক্ষোভ আছে, হতাশা আর বিষণ্নতা আছে। (প্রথম আলো, ১৬-২০ জুলাই)
গুলশান ও শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানের হামলার কয়েক দিন পর বণিক বার্তা পত্রিকায় একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থীই হতাশ ও বিষাদগ্রস্ত।
কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতার মূল উপজীব্য বিষণ্নতা ও হতাশা। রবীন্দ্রনাথে বিষণ্নতা আছে, কিন্তু হতাশা-নৈরাশ্য নেই। রবীন্দ্রনাথ আশাবাদী, আলোর সন্ধানী। বিপরীতে জীবনানন্দ আমৃত্যু হতাশাগ্রস্ত আর বিষাদময়। ষাটের দশকে তরুণেরা হতাশা আর বিষণ্নতায় ডুবে ছিল; ওই প্রজন্মকে বলা হতো ‘স্যাড জেনারেশন’। এখন মনে হচ্ছে, নতুন এক ‘স্যাড জেনারেশন’ যেন জঙ্গিবাদের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। ষাটের দশকের স্যাড জেনারেশনের বিষণ্নতা আর হতাশার প্রকাশ ছিল সৃষ্টিশীল পথে, যেমন তাঁদের গল্প, কবিতা, গানে। আর বর্তমানের স্যাড জেনারেশন মানুষকে হত্যা করে তাদের বিষণ্নতা আর হতাশার প্রকাশ ঘটাচ্ছে। মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েডের মতে, মানুষের মধ্যে ‘ইরোস’ আর ‘থ্যানাটোস’ নামে পরস্পরবিরোধী দুটি শক্তি সমভাবে ক্রিয়াশীল; একটির কারণে মানুষ জীবনবাদী হয়, সৃজনশীল পথে চিন্তা ও অনুভূতির প্রকাশ ঘটায়। আর থ্যানাটোসের কারণে মানুষ হয় মৃত্যুমুখী—অন্ধকার আর ধ্বংসাত্মক পথে যার প্রকাশ ঘটে। তারুণ্যের শক্তির কী অপচয়! এ কথা তো ঠিক যে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে বেশি আত্মত্যাগ করেছে তরুণসমাজ। বর্তমান বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৬৫ শতাংশই তরুণ—এখনই এই ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’ কাজে লাগিয়ে উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার মোক্ষম সময়। কিন্তু সেই তরুণদের একাংশ এখন হতাশা আর জঙ্গিবাদের দিকে ঝুঁকছে! তরুণ জঙ্গিরা এতটা ‘হাইলি মোটিভেটেড’ যে নিজেকে ধ্বংস করে হলেও তারা অন্যদের হত্যা করতে দ্বিধা করছে না। তারুণ্যের এই শক্তিকে সৃষ্টিশীল আর উৎপাদনশীল খাতে কাজে লাগানো গেলে বাংলাদেশের উন্নয়ন কে পারে ঠেকিয়ে রাখতে?
বিষাদগ্রস্ত তরুণদের সহজে জঙ্গিবাদে কবজা করা যায়। তার মানে শুধু আর্থিক অসচ্ছলতা নয়, হতাশ তরুণদের জঙ্গিবাদে দীক্ষা দেওয়া সহজ। তরুণটি কোন পরিবারের সেটা মুখ্য নয়। মুখ্য হলো সে তার সামনে কোনো আশার আলো দেখতে পাচ্ছে কি না। তাদের সামনে কোনো রোল মডেল আছে কি না, যাকে তারা আদর্শ জ্ঞান করে অনুসরণ করতে পারে। জঙ্গিবাদ আরেকটি নির্মম সত্যের মুখোমুখি আমাদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, তা হলো আগে বিভিন্ন ঘটনায় দেখা গেছে জঙ্গি হামলায় অংশগ্রহণকারীরা মাদ্রাসার ছাত্র বা অসচ্ছল পরিবারের সন্তান। কিন্তু গুলশান, শোলাকিয়া ও কল্যাণপুরের ঘটনায় তরুণেরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থী এবং এরা প্রায় সবাই সচ্ছল পরিবারের সন্তান। এসব সচ্ছল পরিবারের সন্তানেরা কেন জঙ্গি হচ্ছে? তার মানে পেটের দায়ে জঙ্গি হয় না। হয় ‘মতাদর্শে’র দায়ে। সে মতাদর্শ ভুল বা ঠিক হোক।
হতাশাগ্রস্ত, পারিবারিক বন্ধন থেকে বিচ্ছিন্ন এবং ধর্মের সঠিক জ্ঞান যাদের মধ্যে নেই কিন্তু ধর্মের প্রতি আছে প্রবল আকর্ষণ—এমন তরুণকে পবিত্র কোরআন-হাদিসের অপব্যাখ্যা দিয়ে মগজ ধোলাই করা হচ্ছে। বিস্ময়কর হলো, জঙ্গি হামলার পরিকল্পনাকারীরা হত্যাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে মাদ্রাসায় পড়া প্রান্তিক শ্রেণির শিক্ষার্থী আর ইংরেজি মাধ্যমে পড়া উচ্চবিত্ত শ্রেণির শিক্ষার্থীদের একত্র করতে পেরেছে। জঙ্গি নেতাদের মধ্যে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও পাচ্ছি। তবে কি মাদ্রাসা ও ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘একই ধরনের মানসিকতাসম্পন্ন’ মানুষ তৈরি করছে?
দুই শ্রেণির শিক্ষার্থীরাই শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন। তাদের মধ্যে নিজস্ব সংস্কৃতি, ইতিহাস আর ঐতিহ্যের প্রতি নেই কোনো অঙ্গীকার; বিপরীতে তাদের মধ্যে একধরনের বিচ্ছিন্নতাবোধ তৈরি হচ্ছে। এই বিচ্ছিন্নতাবোধ তৈরির দায় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও মুক্ত নয়। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়ার পর তাকে শুধু একাডেমিক শিক্ষা নয়, তার চিন্তাভাবনা, ধ্যানধারণা, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার সব পথ ও পরিবেশ তৈরি করে দেওয়ার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের। কিন্তু অকপটে স্বীকার করতে হবে, আমরা এখানটায় ব্যর্থ হয়েছি।
তরুণেরা ঝুঁকছে ভার্চুয়াল জগতে। ইন্টারনেট ব্যবহার খারাপ কিছু নয়, কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারে এর ওপর নির্ভরতা বাড়ে; মোহ তৈরি হতে থাকে। ইন্টারনেটে আসক্ত তরুণেরা অনলাইনভিত্তিক প্রতারণামূলক বিষয়গুলোও বিশ্বাস করতে শুরু করে। কারণ, সে আর বাস্তব জগতে বিচরণ করে না। বিচরণ করে কাল্পনিক এক অলীক দুনিয়ায়, এক মোহনীয় কিন্তু মায়াবী জগতে। ইন্টারনেট তাকে টেনে নিয়ে যায় স্বপ্নময় এক হাতছানির জগতে। তাদের সামনে মেকি এক ‘বাস্তবতা’ নির্মাণ করে দেয়। এর ফাঁদে তারা পড়ছে। সেলফোন, ট্যাব, ল্যাপটপে মুখ গুঁজে রাখছে; এ যেন এক ‘মাথাগোঁজা জেনারেশন’! সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো এই সুযোগই নিচ্ছে। এক মিথ্যা, বর্বর আর নিষ্ঠুর সংস্কৃতি খুব দ্রুত তরুণদের মাথায় চালান করে দিচ্ছে।
জঙ্গিবাদ উত্তরণে করণীয় কী? সহজ রাস্তা নেই। জঙ্গিবাদের সমস্যা বৈশ্বিক; বিশ্বরাজনীতির শক্তি ভারসাম্য, অস্ত্র ব্যবসা, জ্বালানি তেলের বাজার দখল, ক্ষমতাবান রাষ্ট্রসমূহের আধিপত্যের লড়াই, ধর্মীয় জাত্যাভিমান, বৈষম্য, দুর্নীতি, গণতন্ত্রহীনতা, সুশাসনের অভাব—এ রকম অনেক বিষয় জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িত। এর বিরুদ্ধে লড়াই তাই দীর্ঘমেয়াদি; এককভাবে বাংলাদেশ জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পারবে না; তবু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।
যেমন দেশে একটি সাংস্কৃতিক গণজাগরণ তৈরি করতে হবে। জেলা-উপজেলায় শিল্পকলা একাডেমি, শিশু একাডেমীগুলো এখন ঘুমোচ্ছে—এদের জাগিয়ে তুলতে হবে; শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও বিতর্ক প্রতিযোগিতার মতো সহশিক্ষা কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করা দরকার।
প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে জঙ্গিবাদবিরোধী কমিটি গঠন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যেসব স্থানে জঙ্গিবাদ নিয়ে বৈঠক হতে পারে, সে জায়গাগুলো চিহ্নিত করে নজরদারি বাড়াতে হবে। শিক্ষার্থীরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়মিত হলে অবশ্যই অভিভাবকদের জানাতে হবে। যৌক্তিক কারণ ছাড়া কোনো শিক্ষার্থী শ্রেণিকক্ষে অনুপস্থিত থাকলে পুলিশকে জানানো দরকার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদবিরোধী গবেষণা সেল থাকা দরকার। একাডেমিক কার্যক্রমে নৈতিকতা ও নন্দনতত্ত্বের মতো বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। সন্ত্রাসবাদবিরোধী কর্মসূচি, যেমন সেমিনার, আলোচনা সভায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিয়মিত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। লাইব্রেরি, ইন্টারনেট, বন্ধুবান্ধব বা শিক্ষকের মাধ্যমে তরুণেরা যাতে জঙ্গিবাদী ধ্যানধারণার সঙ্গে যুক্ত হতে না পারে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তরুণদের মধ্যে পাঠাভ্যাস গড়ে তুলতে হবে; মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ সম্পর্কে জানানোর ব্যবস্থা করতে হবে এবং তাদের মধ্যে মানবিকতা, পরার্থপরতা ও দেশপ্রেম জাগাতে হবে।
অভিভাবকদের উচিত হবে সন্তানকে সময় দেওয়া; সমবয়সী বন্ধুবান্ধবেরও উচিত তাদের সহপাঠীদের খোঁজখবর নেওয়া।
সর্বোপরি পরিবার ও সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রে বহুত্ববাদী চেতনার উন্মেষ ঘটাতে হবে।
আমরা মনে করেছিলাম, সাড়ে চার দশকে ভূরাজনীতির গতিপ্রকৃতি যেমন পাল্টেছে, জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা, মন-রুচিও অনেক পাল্টেছে। তাই এখন যে সংবিধান রচিত হবে, তাতে বহুত্ববাদী চেতনার প্রতিফলন থাকতে হবে; সংবিধান রচিত হবে মাল্টিকালচারিজম আর প্লুরালিজমকে ধারণ করে। রাষ্ট্রকে এখন তাই কেবল ধর্মনিরপেক্ষ হলেই চলবে না, একই সঙ্গে ভাষানিরপেক্ষ, জাতিনিরপেক্ষ, যৌনতানিরপেক্ষ ও লিঙ্গনিরপেক্ষ হতে হবে।
রোবায়েত ফেরদৌস: সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
robaet.ferdous@gmail