কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিমানবন্দর থেকে মারুতি ৮০০-তে চেপে থামেলে যাচ্ছিলাম। নেপাল আমার খুব প্রিয়, কিন্তু দেশটিকে আমরা ‘গরিব’ হিসেবেই বিবেচনা করি। হঠাৎ নিজের ভাবনাটাই কেমন যেন কানে বাজল। যে দেশে হিমালয় দাঁড়িয়ে আছে, আর পাহাড়, উপত্যকা, মানুষ মিলে প্রকৃতির অসাধারণ রূপ, যেখানকার মানুষগুলো এত অতিথিপরায়ণ, যে দেশের রাজধানী ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করছে, যে দেশের মানুষ এখনো নিজস্ব সংস্কৃতি ও শিল্পকে ধরে রেখেছে, হাজার পদের ফুল-ফল পাওয়া যায় যে দেশে, সেই দেশ কেন ‘গরিব’ হবে! আমার এক বন্ধু নেপালে ট্রেকিং করে এসে জানিয়েছিল, সে নাকি নামমাত্র মূল্যে কিংবা কোথাও বিনা মূল্যে কেবল খাওয়ার খরচটা দিয়ে পাহাড়ি আদিবাসীদের লজিংয়ে থেকেছে। আমাদের কাছে এরাই ‘গরিব’ হিসেবে বিবেচিত।
এবার বর্ষায় বাংলাদেশের স্বরূপকাঠি গিয়েছিলাম পেয়ারা বাগান দেখতে। অদ্ভুত সুন্দর গ্রামবাংলা! ইঞ্জিনচালিত নৌকায় যখন বাগানের ভেতরের দিকে যাচ্ছিলাম, পেয়ারা-বোঝাই নৌকাগুলো থেকে মাঝিরা পেয়ারা ছুড়ে দিয়ে অভ্যর্থনা জানাচ্ছিলেন। নৌকায় করে ছোট ছোট শাখানদী ধরে গ্রামের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলাম গ্রামবাসীর বাড়িঘর, আঙিনা কিংবা ঘাট পেরিয়ে। বাড়ির মেয়েদের ঘাটে গোসল করতে দেখে কোনো মাঝি কটূক্তি করছেন না বা দাঁড়িয়ে দেখছেন না। এই পেয়ারা বাগানের আশপাশে টয়লেটের ব্যবস্থা নেই। দুপুরে খাওয়ার পর আশপাশে জিজ্ঞাসা করতেই সবাই বলল, ‘যেকোনো এক বাড়িতে চলে যান, আপা।’
খুব লজ্জা ও শঙ্কা নিয়ে এক বাড়িতে বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করতেই দৌড়ে গিয়ে আগে তাদের টয়লেটটা পরিষ্কার করে, চাপকল থেকে পানি নিয়ে আমাকে দিল। নিজের মনে প্রশ্ন জাগল, আমার বাড়ির দরজায় কড়া নেড়ে অপরিচিত কেউ এলে আমি কি তাঁকে আমার টয়লেটটা ধুয়ে পরিষ্কার করে ব্যবহার করার অনুমতি দিতাম?
বাড়িগুলোর আঙিনায় প্রচুর ফলের গাছ—জাম্বুরা, পেয়ারা, আমড়া।
জানতে চাইলাম, ‘আপনারা এসব ফল খান না?’ উত্তর পেলাম, ‘অনেক খাই। তা-ও অনেক হয়। আপনি নেবেন কিছু? দিয়ে দিই?’ কী উদার আতিথেয়তা! অথচ এঁরা আমার দেশের ‘গরিব’ মানুষ!
বাড়ি ফিরে গুগলে সার্চ করে দারিদ্র্যের সংজ্ঞা খুঁজলাম। বিশ্বব্যাংকের মতে, যারা দিনে ১ দশমিক ৯ মার্কিন ডলার বা
১০০ টাকার নিচে জীবনযাপন করে, তারা হতদরিদ্র। আর যারা দিনে ৩ দশমিক ১ ডলার বা ২৫০ টাকার নিচে ব্যয় করে, তারা মধ্যম দরিদ্র।
কাঠমান্ডুতে দেখেছি, নেপালের মানুষগুলো এখনো হেঁটে চলে, দেশের তৈরি বা নিজের হাতে তৈরি জিনিসের প্রাধান্য দৈনন্দিন ব্যবহার্যে বেশি, মাটির ওপর খালি পায়ে হাঁটে, কাঠের তৈরি বাপ-দাদার বাড়িতে থাকে কিংবা অদৃশ্য অমৃতের খোঁজে সর্বোচ্চ গতিবেগে সারাক্ষণ ছোটে না। এই নেপাল আমাদের কাছে গরিব দেশ!
ঢাকায় ৩২ ডিগ্রি গরমে, কাঠফাটা দুপুরে, পিচঢালা রাস্তায় জুতো পায়ে, ডেনিম জিনস কিংবা চাপা ফরমাল প্যান্টের সঙ্গে ফুলহাতা শার্ট বা কালো সিনথেটিক গেঞ্জি পরে, হাতে তালুসমান টাচস্ক্রিন মুঠোফোনে, আনমনে উষ্ণমুখে কথা বলতে বলতে রাস্তা পার হওয়া ছেলেদের দেখে, সরু রাস্তায় যানজটে দাঁড়ানো, ১০ বাই ৬ ফুট আকারের বড় বড় গাড়ি দেখে, গুলশান-বনানী-ধানমন্ডি-বেইলি রোডের খাবারের দোকানে বহু গুণ বেশি দামে কিশোর-কিশোরীদের চা, কফি কিংবা আইসক্রিম খেতে দেখে বা বিদেশি ফ্যাশনে সুগন্ধি মাখা ছেলেমেয়েদের দেখে বলি, বাংলাদেশ ‘উন্নত’ হয়েছে। নদীমাতৃক দেশের উর্বর সমতলে আকাশছোঁয়া ভবন দেখে, বন উজাড় চাষের জমির ওপর কলকারখানা দেখে বা বন উজাড় করে বিদ্যুৎকেন্দ্র বানানোর উদ্যোগ নিয়ে আমরা চেঁচিয়ে উঠি—বাংলাদেশ আর ‘গরিব’ নেই।
চাষি-মাঝিদের বাস্তুহারা করে, সুতির ফতুয়ার বদলে কলার-শার্ট, লুঙ্গির বদলে প্যান্ট পরিয়ে, গলায় ফিতা ঝুলিয়ে, তাঁদের গান-সাধনা বন্ধ করে, হাতে স্টেইনলেস স্টিলের লাঞ্চ বাক্স ধরিয়ে দিয়ে, নয়টা-সাতটা অফিসে পাঠিয়ে আমরা সন্তুষ্টির হাসি হাসি—‘বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হয়েছে’। আমরা তাতেও ক্ষান্ত নই, আমাদের আরও উন্নতি দরকার, আমরা উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ হতে চাই। ১৬ কোটি মানুষের হাতে যত অর্থ আসবে, ততই পণ্যের চাহিদা বাড়বে, জিনিসের মূল্য বাড়বে। উৎপাদনক্ষমতা বাড়াতে আরও মানুষ, আরও জায়গার প্রয়োজন হবে।
‘অর্থনৈতিক উন্নয়ন’ শহরের জন্ম দেয়। দলে দলে মানুষ গ্রাম থেকে শহরে এসে ভেড়ে। তাতে গ্রাম খালি হয়, চাষ করার লোক পাওয়া যায় না, জমি খালি হয়, জমির মূল্য কমে যায়। কিছু মানুষ বসে থাকে সেই জমিগুলো কিনে নিতে। সেই টাকা নিয়ে গ্রামবাসী শহরে আসে, ‘উন্নত’ হতে। শহর হলো বাজার, বিদেশি পণ্যের বাজার। এখানে সবকিছু বেচাকেনা হয়। শ্রম, বিবেক, ফ্যাশন, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, ভাষা, শিক্ষা, স্বাদ, আনন্দ, আদর, ভালোবাসা। বিশ্বের কোনো এক প্রান্তে বসে কিছু মানুষ নিজেদের স্বার্থে পুরো বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ে নাড়াচাড়া করে। গণমাধ্যম সেগুলো প্রচার করে, শহর সেই সব পণ্য নিয়ে নিজেদের পসরা সাজায়। গ্রাম থেকে নিজেদের ভিটে বিক্রি করে আসা মানুষগুলো সেই ভিটে বিক্রির অর্থ দিয়ে সেসব কিনে নেয়। এই বেচাকেনার খেলায় যে সবচেয়ে বেশি কিনবে তার জয়, সে ‘উন্নত’, সে ‘ধনী’। যে ক্রয়ক্ষমতা থেকে যত পিছিয়ে, সে ততই ‘গরিব’, ততই ‘অনুন্নত’।
বিশ্বব্যাংকের ভাষায়, ‘দিনে ১ দশমিক ৩ ডলারের নিচে ব্যয় করা মানুষ হতদরিদ্র।’ যারা ভোররাতে ঘুম ভেঙে উঠে উপাসনা করে, যোগব্যায়াম করে, খালি পেটে এক গ্লাস চিরতার রস খায়, বাতাসের গতি দেখে, মাটির গন্ধ শুঁকে বলে দিতে পারে কখন ও কতটা বৃষ্টি হবে, যাদের শ্রমে জমির উর্বরতা বাড়ে, যাদের ভালোবাসায় গাছ ফল দেয়, যারা রোগ-শোকে ভেষজ প্রতিকার খোঁজে, যারা নিজের শরীর বোঝে, সৃষ্টিকর্তার নেয়ামতে মাথা নত করে, মাঝরাত পর্যন্ত জেগে থাকে না, তারা আয়-ব্যয়ের হিসাব–নিকাশে ‘গরিব’ মানুষ। আর মানুষ যত বেশি তার শিকড় থেকে নিজেকে সরিয়ে নেবে, যত বেশি বিদেশি শহুরে পণ্যে নিজেকে সাজাবে, তত বেশি ‘উন্নত’ হবে, ধনী হবে।
স্বরূপকাঠির মানুষগুলো যখন নিজেদের যত্নে বড় করা গাছের ফল-সবজি বাদ দিয়ে বাজার থেকে কেনা ফরমালিনযুক্ত বা হিমায়িত খাবার ১০ গুণ বেশি দামে কিনে খাবে, বড় বড় অট্টালিকার দরজায় দারোয়ান দাঁড় করিয়ে রাখবে, যাতে অপরিচিত কেউ টয়লেট করতে এলে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া যায়; মানুষ যখন পকেটের পয়সা খরচ করে টয়লেট করবে, পাহাড়ের মানুষগুলো যেদিন তাদের অতিথিপরায়ণতা বাদ দিয়ে বহিরাগতদের সন্দেহের চোখে দেখবে, মানুষকে আর নিজের বাড়িতে অভ্যর্থনা জানাবে না, সেদিন আমরা গর্বের সঙ্গে বলব—এই অঞ্চলের মানুষ আর ‘গরিব’ নেই।
আইরিন খান: গবেষক। উন্নয়নকর্মী।