'ক্ষমতা যার জলা তার'
শম্ভু হাওলাদার গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মহিমাগঞ্জ ইউনিয়নের মত্স্যজীবী সমিতির সভাপতি। একটি বেসরকারি টেলিভিশনে তিনি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘ক্ষমতা যার জলা তার’।
এই বক্তব্য প্রচারিত হওয়ার পর গত শনিবার তাঁকে একই গ্রামের কয়েকজন দুর্বৃত্ত নির্মমভাবে পিটিয়েছে। যারা মেরেছে তারাই যে সেই জলমহালভোগী ‘ক্ষমতাধর’, এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। অবৈধভাবেই এখন জলমহাল কিংবা জলাশয় ক্ষমতাধর ব্যক্তিরাই ভোগ করে থাকেন। এ কথা তো গোপন কিছু নয়।
খাস জলাশয় এবং জলমহাল ইজারা দেওয়ার জন্য ‘সরকারি জলমহাল ব্যবস্থাপনা নীতি-২০০৯’ বিদ্যমান আছে। এই নীতিমালায় উল্লেখ আছে, ‘জাল যার জলা তার’। এই নীতিমালার ২ নম্বর ধারার ‘খ’ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কোনো সমিতিতে যদি এমন কোনো সদস্য থাকেন যিনি প্রকৃত মত্স্যজীবী নহেন তবে সে সমিতি কোনো সরকারি জলমহাল বন্দোবস্ত পাওয়ার যোগ্য হবে না।’ এই ধারারই ‘ক’ অনুচ্ছেদে প্রকৃত মত্স্যজীবীর সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘যিনি প্রাকৃতিক উৎস হতে মাছ শিকার এবং বিক্রয় করেই প্রধানত জীবিকা নির্বাহ করেন তিনি প্রকৃত মত্স্যজীবী বলে গণ্য হবেন।’
এই নীতিমালা বাস্তবে যথাযথভাবে ব্যবহার করা হয় না। দেশজুড়ে ক্ষমতা যার, তারাই জলমহাল ভোগ করে আসছে। ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে প্রথম আলো পত্রিকায় ‘দেওনাই নদী কি “জলমহাল” হবে?’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম। নীলফামারী জেলার সদর উপজেলায় কতিপয় অসাধু ব্যক্তি একটি সংগঠনের নামে মাছ ছেড়ে নদীটি দখল করে নিয়েছিলেন। ওই সমিতিতে মত্স্যজীবীদের কেউ ছিল না। বরং প্রকৃত মত্স্যজীবীরা মাছ ধরার জন্য নদীতে নামতে পারতেন না।
কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলার সদর ইউনিয়নে চাকিরপশার নদী আছে। নদীটি মূলত বুড়িতিস্তা নামক একটি নদীর উজানের অংশ। নদীটির একটি অংশ অনেক প্রশস্ত এবং গভীর। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর এ নদীর ১৬১ একর জমি জলমহাল হিসেবে বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। স্থানীয়ভাবে কারও অজানা নয়, এই বন্দোবস্ত মত্স্যজীবীরা ভোগ করেন না। এই জলমহাল কখনো মত্স্যজীবীর নামে ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা ভোগ করেছেন, কখনো এমনও হয়েছে, বিত্তশালী কেউ হয়ে উঠেছেন মত্স্যজীবী সমিতির সভাপতি। চলতি বছরেও জেলেরা ভোগ করতে পারছেন না এই নদীর জলমহাল।
যে প্রক্রিয়ায় জলমহাল বন্দোবস্ত দেওয়া হয়, সেই পদ্ধতিতে মত্স্যজীবী ছাড়া অন্য কেউ ইজারা পাওয়ার কথা নয়। তারপরও সরকারি অনেক কর্মকর্তাকে ফাঁকি দিয়ে অথবা যোগসাজশে বছরের পর বছর ধরে জলমহাল ক্ষমতাধরেরাই ভোগ করে চলছেন। যেসব প্রভাবশালী ব্যক্তি এ কাজ করেন, তাঁদের স্থানীয় পেটোয়া বাহিনী থাকে। তাঁদের ভয়েও অনেকে কথা বলতে পারেন না।
সম্প্রতি চাকিরপশার নদীতে গিয়েছিলাম। চান্দামারী নামক গ্রামের পাশে একটি স্থানে মাছের অভয়ারণ্য করা হয়েছে। এই অভয়ারণ্যের মাছ ওষুধ দিয়ে মারা হয়—এমন অভিযোগ করলেন স্থানীয় আবদুল মতিন। অভয়ারণ্যের পাশে নদীতে মাইদুল ইসলামসহ কয়েকজনকে মাছ ধরতে দেখি। মাইদুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, তিনি এ নদীতে মাছ চাষ করলেও সরকারের কাছ থেকে বন্দোবস্ত নেননি। তিনি দুজনের কাছ থেকে ইজারা নিয়েছেন। কীভাবে ইজারা নিয়েছেন—এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমরা একটি খসড়া ডিড করে ২ লাখ ১০ হাজার টাকা দিয়ে নিয়েছি।’ মাইদুল ইসলাম যে দুজনের কাছ থেকে ইজারা নিয়েছেন, তাঁদের একজনের নাম ‘যোগেন’, তিনি জেলে। অন্যজনের বংশে কেউ জেলে নেই।
নব্বইয়ের দশকে এই নদী বন্দোবস্ত শুরু হওয়ার পর থেকে আর কেউই মাছ ধরতে পারেন না। বন্যার সময় পানি নদীর এলাকা ছেড়ে উঁচু জমিতে গেলে সেই স্থানেও মাছ ধরতে দেওয়া হয় না। নদীর পাড়েই এক তরুণ আক্ষেপ করে বলছিলেন, ‘ঢাকায় থাকি। একদিন বরশি ফেলছিলাম। একজন এসে সেই বরশি কেড়ে নিয়ে গেছে। দুঃখের কথা আর কী বলব?’
জলমহাল ব্যবস্থাপনা আইন লঙ্ঘন করে পাঠানহাট নামক স্থানে নদীর ওপর আড়াআড়ি সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। একসময় প্রয়োজনের তুলনায় অনেক ছোট সেতু ছিল। স্থানীয় দখলদারেরা সেই সেতুটিও তুলে দিয়ে পুকুর বানিয়ে মাছ চাষ করছেন। এ নদীর পাড়ে নাফাডাঙা নামক স্থানে কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়। সেখানে প্রত্যেকের অভিযোগ, কয়েকজন দখলদারের কারণে এই নদীতে শখ করেও আর মাছ ধরা যায় না।
এই নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন নদীপাড়ের কৈলাশকুটি গ্রামের আবুল কালাম। তিনি বলছিলেন, ‘যামরা জেলে নোয়ায় (নয়) তারাই এ নদীর মাছ খায়। এটে দেড় শ জন জেলের কার্ডও আছে। হামরা আন্দোলনও করছি। কোনো লাভ হয় নাই। জেলের কোনো অধিকার নাই।’ আবুল কালামের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একজন নারী বলছিলেন, ‘গাও ধুবার জন্য নদীত নামলেও দূর থাকি চিকরি (চিত্কার দেওয়া) ওঠে। নাইমবারও দেয় না।’
জলমহাল ব্যবস্থাপনা নীতিমালার ২১ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘বন্দোবস্তকৃত/ইজারাকৃত জলমহালের কোথাও প্রবহমান প্রাকৃতিক পানি আটকে রাখা যাবে না।’ চাকিরপশার নদীতে এই আইন পরাহত হয়েছে বন্দোবস্ত শুরু হওয়ার পর থেকেই। নদীর পানি এমনভাবে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে যে নদীটি নদী হিসেবে তার পরিচিতি হারাতে বসেছে। নদীর পানিপ্রবাহ বন্ধ হওয়ার কারণে চাকিরপশার উজানে ছাটমল্লিকবেগ, দিনা, নাটুয়ামহল, পুটিকাটা, পুনকর, চেতনা, দেবীচরণ, দক্ষিণ প্রাণপতি মৌজার ২০ হাজার একর দোফসলি জমি জলাবদ্ধতাজনিত কারণে এক ফসলি জমিতে পরিণত হয়েছে। কোনো বছর আগাম বর্ষা দেখা দিলে কোনো ফসলই হয় না। ফলে হাজার হাজার পরিবারে নেমে এসেছে চরম দুর্ভোগ।
শম্ভু হাওলাদারের মতো হাজার হাজার জেলের জাল থাকলেও জলমহালে তাঁদের অধিকার নেই। শম্ভু হাওলাদারেরা দুর্বল। রাষ্ট্র তাঁদের পাশে দাঁড়ালে তাঁরা দুর্বৃত্তদের চেয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। সরকারের উচিত সারা দেশের জলমহাল, জলাশয়গুলোর প্রকৃত অবস্থা জেনে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা। কিন্তু সরকার কি সেই পদক্ষেপ গ্রহণ করবে?
তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভরাইন পিপলের পরিচালক
wadudtuhin@gmail. com