'কবে ধান কেনবে বাপ?'
হঠাৎ করে ধান পাকেনি। মৌসুমের আগেও ধান আসেনি বাজারে। চাষি এই ধান বেচে রবিশস্য ধরবেন। কেউ যাবেন ইরি-বোরোতে। ধানের দাম পেলে তার এক পরিকল্পনা, না পেলে অন্য চিন্তা। মৌসুমের শুরুতে ধানের প্রধান ক্রেতা চালকলের মালিকেরা যা করেন, এবারও তা-ই করছেন। তাঁরা ফড়িয়াদের বলে দিয়েছেন ‘ধীরে চলো’। চালের দাম ‘পড়তির দিকে’ আর কত লোকসান গুনাবে। চাষি হাটে ধান নিয়ে এসে দেখছেন ক্রেতা নেই, দাম নেই। বিরামপুরের কাটলা ইউনিয়নের শইলান গ্রামে পা রাখার আগে রাস্তার পাশের চায়ের দোকানে একটু জিরিয়ে নেওয়ার জন্য বসা। সেখানে শূন্যদৃষ্টি মেলে বসে থাকা এক চাষি জানতে চান, ‘কবে ধান কেনবে বাপ?’
সরকার বলেছিল, প্রতি কেজি ২৬ টাকা দরে কেনা হবে ধান। এখন বাজারে ১৫ টাকা দামও পাওয়া যাচ্ছে না। কৃষিমন্ত্রীর প্রচণ্ড রক্ষণশীল হিসাব আমলে নিলে কেজিপ্রতি ধান উৎপাদন করতে কৃষকের খরচ পড়েছে কমপক্ষে ২১.৫০ টাকা। এই অবস্থায় চালকলের মালিকেরা দাম আরও কমানোর কৌশল হিসেবে হাত গুটিয়ে নিয়েছেন। আড়তদারেরা বলছেন, ধান ফিরিয়ে নিয়ে না গেলে রেখে যেতে পারো, বেচে পয়সা দেব। নওগাঁর পত্নীতলা উপজেলার ধান কেনাবেচার বড় হাট মধইলবাজারে এসে আকবরপুর গ্রামের চাষি সাইফুল ইসলামের (৫৫) সে রকম অভিজ্ঞতা হয়েছে। ১০ মণ স্বর্ণা ধান নিয়ে এসে ক্রেতা না পেয়ে এক আড়তদারের কাছে বাকিতে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন তিনি।
কেন ধান কেনা যাচ্ছে না?
সহজ উত্তর, তালিকা চূড়ান্ত হয়নি। অর্থাৎ কার কাছ থেকে কর্তারা ধান কিনবেন, আর কাকে তালিকার বাইরে রাখবেন, সেটা এখনো ঠিক করতে পারেননি তাঁরা। এর আগে কৃষিমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, নভেম্বরের ১০ তারিখের মধ্যে তালিকা চূড়ান্ত হয়ে যাবে। ইউনিয়নভিত্তিক সেই তালিকা অনুযায়ী উপজেলায় ধান-চাল কেনার সরকারি কমিটি একটা চূড়ান্ত তালিকা করবে। তবে কোন ইউনিয়ন থেকে কতজন চাষির ধান নেওয়া হবে, সে ঘুড়ির লাটাই থাকবে ঢাকায়। ঢাকার ঠিক করে দেওয়া সংখ্যার থেকে তালিকার চাষির সংখ্যা বেশি হলে লটারি হবে। এটা কি ক্যাসিনো-চর্চার আসর? বাজি ও অদৃষ্টের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আসার পথ আর থাকল কোথায়? একটি বিদেশি সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কৃষিমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, যাতে প্রান্তিক কৃষকের কাছ থেকে বেশি কেনা যায়, তাই দুই টনের বেশি ধান কারও কাছ থেকে নেওয়া হবে না। দুই টন কেন, প্রকৃত উৎপাদকের কাছ থেকে নগদ মূল্যে এক টন কিনলেও সে চট করে রবিশস্য চাষে যাওয়ার একটা জোর পায়। এবার পেঁয়াজের দাম আকাশছোঁয়ায় রবিশস্যের ওপর চাপটাও বেশি। পেঁয়াজের বীজ আর চারার দাম এর মধ্যেই ১০ বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। কুষ্টিয়ার যে বীজ বিক্রেতা বছরে এক মণ পেঁয়াজের বীজ বিক্রি করতে হিমশিম খেতেন, তিনি সপ্তাহখানেক আগে জানিয়েছেন, তাঁর দেড় মণের কিছু বেশি বীজ এরই মধ্যে বিক্রি হয়ে গেছে।
নিয়ম রক্ষার খাতিরে ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত শুধু ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর উপজেলার দুজন কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনা হয়েছে। লটারির মাধ্যমে কৃষকের তালিকা চূড়ান্ত না হওয়ায় কেনা শুরু করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছে সেখানকার খাদ্য বিভাগ। তালিকা যখন চূড়ান্ত হয়নি, তখন কী করে দুজনের কাছ থেকে ধান কেনা হলো—সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজি হননি হরিপুর উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তা।
রাজশাহীতে আমন মৌসুমে সরকারিভাবে ৪ ডিসেম্বর থেকে কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনার কথা ছিল। কিন্তু কৃষকের তালিকা চূড়ান্ত না হওয়ায় লটারি করা হয়নি। ফলে সেদিন ধান কেনাও শুরু করা যায়নি। তারও আগে বলা হয়েছিল রাজশাহীতে চাষিদের কাছ থেকে সরাসরি ৮ হাজার ১৫০ মেট্রিক টন ধান কেনা হবে। কেনার কাজ চলবে ২০ নভেম্বর থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। কেনা যত দেরিতে শুরু হবে, প্রকৃত চাষিদের হাত থেকে ধান ততই চলে যাবে তাদের হাতে, যারা ধান মজুত করতে পারে। অনেকেই মনে করছেন, তালিকা তৈরি, তারপর তা যাচাই-বাছাই, লটারি ইত্যাদি কালক্ষেপণের পাঁয়তারা মাত্র।
যশোরের মনিরামপুরে সরাসরি চাষিদের কাছ থেকে আমন ধান কেনার কাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল ২০ নভেম্বর। ২৭ নভেম্বরেও ধান কেনার সব প্রস্তুত সম্পন্ন করতে পারেননি কর্তারা। মূল তালিকা নিয়েই সেখানে প্রশ্ন উঠেছে। সে তালিকায় নাকি আমন চাষি নন, এমন মানুষের নাম আছে শত শত।
তালিকার এমন লেজেগোবরে অবস্থা এবারই নতুন নয়। ইরি-বোরোর মৌসুমে, তার আগের বছর আমনের সময়, তারও আগে এই একই গান, একই গল্প দেশের মানুষকে শোনানো হয়।
উপায় কি কিছু আছে?
বলতে বাধা নেই চাষির কাছ থেকে সরাসরি ধান কেনা একটি জনপ্রিয় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। ধান-চাল কেনা আর সেটার দেখভালের দায়িত্ব খাদ্য মন্ত্রণালয়ের। তাদের অবকাঠামো, মনমানসিকতা, ক্রয় সংরক্ষণ প্রক্রিয়া—কোনোটাই কৃষকের কথা চিন্তা করে গড়ে ওঠেনি। চরম চাষিবৈরী একটি ব্যবস্থাপনাকে চাষিমনস্ক করে তুলতে না পারলে অব্যবস্থার জট কাটবে না।
মানতে হবে কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনার সক্ষমতা বর্তমানে আমাদের খাদ্য বিভাগের নেই। আর যে পরিমাণ ধান কেনার কথা বলা হচ্ছে, তাতে আদতে চাষিদের অবস্থার উনিশ-বিশ হবে না। ভালো নিয়তে এসব কাজ করতে গেলে সবার আগে দরকার একটা ন্যায্য তথ্যভান্ডার। সাত দিন সময় দিয়ে যে তালিকা তৈরি করা হয়েছে, তাতে ভুল, অসত্য, মিথ্যা, বানোয়াট সবই থাকবে। বেশির ভাগ উপজেলা খাদ্য অফিসে ইউনিয়ন পর্যায়ের কৃষকের কোনো আনুষ্ঠানিক শুমারি করা তালিকা স্থায়ীভাবে থাকে না। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এই তালিকা যথাসময়ে হালনাগাদ না করার কারণে এখন হুড়োহুড়ি করে তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। প্রায় ৪০ মিলিয়ন টনের বেশি ধান এ বছর উৎপাদিত হতে যাচ্ছে, এটা কোনো গোপন তথ্য ছিল কি? বুলবুল সমস্যা করলে কিছু কমত কিন্তু ৩০ মিলিয়ন টনের নিচে যে যাবে না, সেটা সবার জানা ছিল অনেক আগেই। তবু বাজারমূল্যে এই উৎপাদনের প্রভাব পর্যালোচনা করা হয়নি এবং কৃষকের পূর্ণ তালিকা তৈরির জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। কার কাছ থেকে ধান কিনতে হবে, এই তালিকা যথাযথ না হওয়ায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কেনার পদ্ধতি পরিষ্কার নয়।
শুমারি ও জরিপ হালনাগাদ করা থাকলে কোন কৃষকের কাছ থেকে কত ধান কিনতে হবে, সেটি জানা সম্ভব হতো। জরিপ থেকে বেরিয়ে আসত, প্রতি কৃষক তাঁর জমিতে কী পরিমাণ ফসল উৎপাদন করছেন।
রাজনৈতিক চমকের মোহে কিছু একটা করার ঝোঁক থাকলে সেটা চাষিদের কোনো কাজে আসে না। প্রকৃতপক্ষে চাষিদের পাশে দাঁড়াতে হলে একটা পরিকল্পিত ও স্বচ্ছ চাষি সংবেদনশীল ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে।
গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক