'একটা রুটি খেয়ে রোজা রাখা যায় না'
খালিশপুর ‘নতুন রাস্তা’
স্টার জুটমিলের যে শ্রমিক ৫ মে দুর্বল শরীর নিয়ে ফ্লোরে মাথা ঘুরে পড়ে যান, তাঁর নামটি অনেক চেষ্টা করেও জানা হয়নি। কিন্তু তাঁর সমস্যা খালিশপুরের প্রায় সব পাটশ্রমিকের সমস্যা। ১৪ সপ্তাহের মজুরি বকেয়া পড়েছে সেখানে। সামনে ঈদ! অনিশ্চয়তায় ভরা সংসারগুলোয় কেউ কারও মুখের দিকে তাকাতে পারছেন না।
ঢাকা ও চট্টগ্রামে এখন শপিং মলগুলোয় উপচে পড়া ভিড়। অনেক টিভি চ্যানেল শপিং মলের কেনাকাটার তাৎক্ষণিক খবর দেশবাসীকে জানাতে সাংবাদিক-ক্যামেরাম্যানদের অনেকটা দোকানে দোকানে নিয়োগ করেছে। খুলনার দৃশ্যটি বেশ বেমানান। বহু শ্রমিক ‘পরিবার’কে পাঠিয়ে দিচ্ছেন নোয়াখালী, মাদারীপুর, পটুয়াখালী, বরিশাল নিজ নিজ বাড়িতে। খালিশপুরে এক অচেনা ঈদ এসেছে এবার।
দূরের বাংলাদেশের যাঁরা খালিশপুরকে চেনেন, তাঁদের এটা জানা। মূলত, ধর্মভীরু দরিদ্র মানুষদের বসতি এখানে। কিন্তু এবারের রমজানে এখানে রোজা রাখা প্রকৃতই কঠিন হয়ে উঠেছে। সারা জীবন রাষ্ট্রীয় পাটকলে জীবন কাটিয়ে দেওয়া প্রায়–বৃদ্ধ একজন শ্রমিকের ভাষায়, ‘সাহরিতে একটা রুটি খেয়ে রোজা রাখা যায় না!’
কিন্তু তারপরও কেউ কেউ রোজা রাখছেন। উপবাস করেই প্রতিদিন রাজপথের আন্দোলনে বসে থাকেন। স্লোগান ধরেন মাঝেমধ্যে। কিন্তু বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠের প্রচণ্ড রোদ আর ঘামে পুড়ে যাওয়া সেসব বিষণ্ন মুখের দিকে ইফতারের আগে আগে বিকেলের হলুদ আলোয় তাকানো কঠিন।
খালিশপুরের এ রকম শ্রমিকদেরই ইফতারের সময় প্রতিদিন একদল তরুণ-তরুণী শরবত খাওয়াতে আসে। প্রথমে নিজেদের টাকায়, পরে বন্ধু-বান্ধব-হিতৈষীদের সহায়তায় ১০ থেকে ১২ দিন ধরে এই উদ্যোগ চলছে। এই দলের রুহুল আমীন, সুজয় সাম্যরা এই কার্যক্রমকে বলছে ‘ছাত্র-শ্রমিক-জনতার ঐক্য’। নিজেদের কাজ নিয়ে কোনো প্রচারে নেই এই তাদের। এ রকম একটি অসামান্য খবর যে বাংলাদেশের কোথাও প্রধান সংবাদ হবে না, এও তাদের জানা।
তবে রুহুল ও সুজয়রা কেবল শ্রমিক নন, পাটকলগুলোকে বাঁচাতেও আগ্রহী। দেশের শিল্প খাত রক্ষার ভাবনা থেকেই শ্রমিকসংগ্রামীদের পাশে হাঁটছে এই তরুণেরা। ঢাকা ও খুলনার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষিত এই তরুণ দল আজ ১৮ মে খালিশপুর নতুন রাস্তায় সব শ্রমিককে ইফতার করাবেন এবং শিল্প রক্ষায় নিজেদের ভাবনার কথাও বলতে চায়—যদি তাদের সুযোগ দেওয়া হয়। স্পষ্টত, এরা দেশটাকে আশার বধ্যভূমি হতে দিতে চায় না।
কিন্তু যশোর-খুলনার আলোচ্য নয়টি কারখানার সামনে চ্যালেঞ্জ আসলে অনেক।
লোকসানের উৎস ও লোকসানের দায়: শ্রমিক ভাষ্য
খালিশপুরের ক্ষুধাপীড়িত শ্রমিকদের দাবি নয়টি। তার মধ্যে আছে চার বছর আগের মজুরি কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী মজুরি দেওয়া, ১৪ সপ্তাহের বকেয়া বেতন এবং পাট কেনার মৌসুমে সময়মতো অর্থ ছাড় করা। দেশের এত উন্নয়ন-অর্জনের মধ্যেও সরকার গঠিত মজুরি কমিশনের ঘোষণা খোদ সরকারি কারখানায় কেন বহু বছর পরও বাস্তবায়ন হয় না, এ বড় বিস্ময় বটে। তবে বাংলাদেশের পাট খাতের জন্য খালিশপুরের শ্রমিকদের তৃতীয় দাবিটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। শ্রমিকদের দাবি না হয়ে এটা বাংলাদেশের পুরো অর্থনীতির প্রধান এক দাবি হয়ে উঠতে পারত। দুর্ভাগ্য বাংলাদেশের সেটা হচ্ছে না।
দেশে-বিদেশে যখন পাটের সুদিন, বাংলাদেশের পাট খাতের শ্রমিকদের তখন বকেয়া পাওয়ার জন্য ধর্মঘটে নেমে শিল্প–অর্থনীতি বাঁচানোর জন্য চিৎকার করতে হচ্ছে। পুরো দৃশ্যটিতে যেন ঠাঁই নিয়েছে আত্মবিনাশের বিপুল আয়োজন।
শ্রমিকেরা জানালেন, প্রতিবছরই পাটকলগুলোকে পাট কেনার টাকা দেওয়া হয় মৌসুম বিদায় নিলে। এ কারণে অনেক সময় ফ্যাক্টরিগুলো এক হাজার টাকার পাট দুই হাজার টাকা দামে কেনে। এতে বেড়ে যায় উৎপাদন খরচ। পণ্য বাজারে সরকারি কারখানার পাটের বস্তা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে। এভাবেই চলছে দশকের পর দশক। পাট খাতের দুর্দশার এই প্রধান কারণের কথা খালিশপুর থেকে ঢাকা পর্যন্ত অনেকেরই জানা। কিন্তু এখাতের ফুলেফেঁপে ওঠা ‘সিন্ডিকেট’ অমরই থেকে গেছে।
খালিশপুরে অবরোধে শামিল শ্রমিকেরা প্রতিদিনকার বক্তৃতায় কারখানাগুলো লোকসানের এ রকম আরও বহু কাহিনি শোনাচ্ছেন। যার মধ্যে আছে অপ্রয়োজনীয় উচ্চ বেতনের কর্মকর্তাদের কথা। আছে নিম্নমানের পাট কেনার অভিযোগও। সেই পাটের ক্রয়স্থল আবার দেখানো হয় প্রকৃত স্থান থেকে দূরে দূরে। এভাবে অসময়ে কেনা নিম্নমানের পাটের সঙ্গে পরিবহন খরচ যুক্ত হয়ে যে জাতীয় লোকসানি অর্থনীতি তৈরি হয়, তার দায় ঢাকার কিছু প্রচারমাধ্যম নিত্যই চাপিয়ে দিচ্ছে শ্রমিকদের ঘাড়ে। এই প্রচারের জোরেই বিগত শতাব্দীর আশি ও নব্বইয়ের দশকে রাষ্ট্রীয় বহু পাটকল বেসরকারি মালিকদের হাতে গেছে। খুলনা ও যশোরে সে রকম পদধ্বনিই শোনা যাচ্ছে আবারও। এবারের আন্দোলনের শেষে শ্রমিকেরা বকেয়া মজুরি পেলেও হয়তো বিনিময়ে বেসরকারিকরণের পক্ষে একটা নীরব সম্মতিও তাঁদের দিতে হবে। দুই সপ্তাহের অকার্যকর অবরোধে প্রথাগত শ্রমিক সংগঠকদের শান্তশিষ্ট মনোভাব দেখে ক্ষুধার্ত শ্রমিকদের অন্তত তাই মনে হচ্ছে।
আন্দোলনের পরিণতি ‘লিডার’দের হাতেই থাকবে?
খুলনায় একটি ব্যতীত সব কটি পাটকলে দর-কষাকষির জন্য নির্বাচিত নেতৃত্ব (সিবিএ) আছে। খালিশপুর থেকে পুরোনো দিনের লড়াকু বাম শ্রমিক সংগঠনগুলো উঠে গেছে বহুদিন। বিএনপিপন্থীরাও আপস নীরব। সিবিএগুলোতে তাই জাতীয় পর্যায়ের একটি সংগঠনেরই একচেটিয়া আধিপত্য। ‘ভোট’ হয়, কিন্তু তারাই জেতে। এই সিবিএনেতাদের পরিচয় শ্রমিকনেতা হলেও শ্রমিকদের মতো খারাপ নেই তাঁরা। স্থানীয় জনপদে তাঁদের রয়েছে প্রবল প্রতাপ ও নিয়ন্ত্রণ। নয় দফা দাবির আন্দোলনেও তাঁদের পরিকল্পনার বাইরে কিছু হয়নি। বিকেল হলে প্রায় দিনই এরূপ নেতৃবৃন্দ সমাবেশস্থলে আসেন। মিছিলের সামনের সারিতেই থাকেন। কড়া ইস্তিরির সফেদ পাঞ্জাবির হাতা ভাঁজ করে জ্বালাময়ী ভাষণ দেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো খালিশপুরের এবারের আন্দোলন জমেনি। রোজার বিকেলে তিন থেকে চার ঘণ্টার অবরোধে জনজীবনে ততটা ব্যাঘাত হয়নি; যতটা হলে সরকার মনোযোগী হয়। আজ ১৮ মে নতুন করে আন্দোলন নিয়ে পুনর্ভাবনা হবে। তবে বিদ্যমান নেতৃবৃন্দ কীভাবে পাট খাত বাঁচাতে চাইছেন। শ্রমিকদের কাছে এ মুহূর্তে তার কোনো স্পষ্ট চিত্র আছে বলে মনে হয়নি। সব জানেন ‘লিডার’রা।
ইতিহাসে খালিশপুর অনেক লিডার দেখেছে। কিন্তু পাট খাত বাঁচাতে শ্রমিকদের মতামত কখনো জাতীয় মনোযোগ পায়নি। এখন সেই সম্ভাবনা আরও কমে গেছে। মাঠে আজকের লিডারদের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী অবশিষ্ট নেই আর। জাতীয় রাজনীতিতেও এই শ্রমিকদের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। যদিও এই শ্রমিকেরাই অনেক ‘লিডার’কে জেলা ও বিভাগ ছাড়িয়ে রাজধানীর বড় নেতার পরিচিতি দিয়েছেন। মন্ত্রী হতে সাহায্য করেছেন। কিন্তু শ্রেণি রাজনীতি গড়তে পারেননি। সেই সুবিধাবাদ আজ শেষ বিধ্বংসী রূপে হাজির হয়েছে। জীবনসায়াহ্নে অনেকেই নিজেদের আবিষ্কার করবেন বেসরকারি কারখানার চুক্তিভিত্তিক শ্রমিকে। যেমনটি ঘটেছে দেশের অন্যত্র, অনেক খাতের অনেক কারখানায়।
তবে পূর্বাপর ঝলসে যাওয়া এই বর্তমানের মধ্যেই রুহুল আমীন ও সুজেয় সাম্যরা পাটশিল্প রক্ষায় কিছু কাজ করতে চান। খুলনার ২৪ হাজার এবং সারা দেশের ৬৪ হাজার শ্রমিকের কাছে বিকল্প কিছু বক্তব্য নিয়ে যেতে চান তাঁরা। তাঁদের বয়স, অভিজ্ঞতা, সামর্থ্য এবং প্রতিবন্ধকতার তুলনায় এ যেন আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন। তবে কি ইতিহাস বাঁক পরিবর্তনের তাগিদ দিচ্ছে?
বোঝা মুশকিল।
কিন্তু বিদ্যমান কোটারি স্বার্থ অতিক্রম করে খালিশপুরের শিল্পাঞ্চলের মতোই বাংলাদেশের সব স্বার্থক্ষেত্র এখন এ রকম দুঃসাহসী ক্ষুদ্রদের অপেক্ষায়।
আলতাফ পারভেজ: গবেষক