'আসাদ গেছে মিছিল নিয়ে'...

গুলিবিদ্ধ আসাদকে (ছবিতে শুধু পা দেখা যাচ্ছে) নিয়ে যাওয়া হচ্ছে হাসপাতালে, ২০ জানুয়ারি ১৯৬৯। ছবি: রশীদ তালুকদার
গুলিবিদ্ধ আসাদকে (ছবিতে শুধু পা দেখা যাচ্ছে) নিয়ে যাওয়া হচ্ছে হাসপাতালে, ২০ জানুয়ারি ১৯৬৯। ছবি: রশীদ তালুকদার

সেদিন শীতের সন্ধ্যায় আমরা পুরান ঢাকায় হাজী ওসমান গণি রোডে আমাদের বাসার ছাদের ওপর উঠেছিলাম। কারণ, মাওলানা ভাসানী নাকি মিছিল নিয়ে গেছেন গভর্নর হাউসে। কোত্থেকে এক ছোকরা খবর নিয়ে এসেছে—
‘গবনার হাউস জ্বালা দিয়া।’

আমরা আগুনের শিখা দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলাম। এমন আগুন না দেখলে হয়! আর ভাসানী যখন মিছিল নিয়ে ঘেরাও করতে গেছেন, আশা করি না জ্বালিয়ে ফিরবেন না।

সেটি ছিল ১৯৬৯ সালের ৬ ডিসেম্বর। মাওলানা ভাসানী সেদিন ‘জুলুম প্রতিরোধ দিবস’ পালনের আহ্বান জানান। পল্টন ময়দানে মাওলানা ভাসানীর বিশাল জনসভার পর বিক্ষুব্ধ জনতা গভর্নর হাউস ঘেরাও করে; পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের এক দশক হওয়ার পর ছাত্রদের মধ্যে যে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছিল, ভাসানী তাতে নতুন মাত্রা যোগ করলেন।

পরদিন হরতাল। ‘গাড়ির চাকা ঘুরবে না, দোকান পাট খুলবে না’। দিন কয়েক পর ভাসানীর ডাকে শুরু হলো ঘেরাও আন্দোলন। প্রথমেই ঘেরাও হলো পাবনার ডিসি অফিস।

সেদিন ২০ জানুয়ারি। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম কমিটির ডাকে পূর্ব পাকিস্তানের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সেদিন পূর্ণ ধর্মঘট। সরকার জারি করেছে ১৪৪ ধারা। ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে জড়ো হয়।

দুপুর ১২টার দিকে বটতলায় এক সংক্ষিপ্ত সভা শেষে হাজার হাজার ছাত্রের মিছিলের সঙ্গে ১৪৪ ধারা ভেঙে এগিয়ে চলেন বামপন্থী ছাত্রনেতা আমানুল্লাহ মূহাম্মদ আসাদুজ্জামান। মিছিলটি চানখাঁর পুলের কাছে এলে পুলিশ হামলা চালায়। ঘণ্টাখানেক সংঘর্ষ চলার পর আসাদসহ কয়েকজন ছাত্রনেতা মিছিলটিকে ঢাকা হলের পাশ দিয়ে শহরের কেন্দ্রস্থলের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে একজন পুলিশ কর্মকর্তা খুব কাছ থেকে রিভলবারের গুলি ছুড়ে আসাদকে হত্যা করেন।

এখনো কানে বাজে, তখন বুয়েটে পড়া আমার বড় ভাই বিকেলে বাসায় ফিরে বলছেন, ‘ছাত্রনেতা আসাদকে তাক করে খুব কাছে থেকে এক পুলিশ অফিসার পিস্তল দিয়ে গুলি করেছে।’ আসাদকে এই সরাসরি টার্গেট করে গুলি করার বিষয়টি সবার জন্য কী এক ভয়াবহ বার্তা দিয়েছিল: বাধা দিলে বাধবে লড়াই।

আসাদের রক্তমাখা শার্ট নিয়ে বেরোল অদম্য মিছিল। যে শার্ট নিয়ে শামসুর রাহমান লিখলেন সুবিখ্যাত ‘আসাদের শার্ট’ কবিতা—

গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিংবা সূর্যাস্তের
জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট
উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায়।
...
আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখন্ড বস্ত্র মানবিক;
আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা।

আসাদের এই মৃত্যু উনসত্তরের গণ-আন্দোলনের অর্গল খুলে দিল। এক স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি করল দাবানল। মিছিল, মিটিং, হরতাল, গুলি, লাশ, ঘেরাও। নতুন স্লোগানে প্রকম্পিত চারদিক, ‘জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো’। গণজাগরণ রূপ নিল গণ-অভ্যুত্থানের। আইয়ুব গেটের নাম পাল্টে হলো আসাদ গেট।

আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান । জন্ম: ১০ জুন ১৯৪২, মৃত্যু: ২০ জানুয়ারি ১৯৬৯
আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান । জন্ম: ১০ জুন ১৯৪২, মৃত্যু: ২০ জানুয়ারি ১৯৬৯



• ২৪ জানুয়ারি গুলিতে নবম শ্রেণির ছাত্র মতিউর এবং ছুরিকাঘাতে রুস্তম নিহত। শহরের নিয়ন্ত্রণভার সেনাবাহিনীর ওপর। অনির্দিষ্টকালের জন্য সান্ধ্য আইন।
• ২৪ জানুয়ারি সেনাবাহিনী ও ইপিআরের বেপরোয়া গুলিতে ঢাকার নাখালপাড়ায় আনোয়ারা বেগম ঘরের ভেতর বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানোর সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত। প্রতিক্রিয়া হয় তীব্র।
• ১৫ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত সার্জেন্ট জহুরুল হক বন্দী অবস্থায় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে গুলিতে নিহত। তাঁর মৃত্যুসংবাদে পরিস্থিতি খুবই উত্তেজনাপূর্ণ।
• সেদিন মাওলানা ভাসানী লক্ষাধিক লোকের জনসভায় দুই মাসের মধ্যে ১১ দফার বাস্তবায়ন এবং সব রাজবন্দীর মুক্তি দেওয়া না হলে খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দেন। তিনি আরও বলেন, প্রয়োজন হলে ফরাসি বিপ্লবের মতো জেলখানা ভেঙে শেখ মুজিবকে ছিনিয়ে আনা হবে।
• সভা শেষে জনতা মন্ত্রীদের গৃহে অগ্নিসংযোগ শুরু করে।
• ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহা নিহত। হাজার হাজার ছাত্র জনতা সান্ধ্য আইন উপেক্ষা করে ঢাকার রাজপথে নেমে আসে।
(তথ্য: বাংলাপিডিয়া।)

উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের অসাধারণ ছবি আছে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই’-এ:

‘‘কালো কালো হাজার হাজার মাথা এগিয়ে আসছে অখন্ড স্রোতধারার মতো। এই বিপুল স্রোতধারার মধ্যে ঘাই মারা রুই কাতলার ঝাঁক নিয়ে গর্জন করতে করতে এগিয়ে আসছে কোটি ঢেউয়ের দল। …গলি-উপ-গলি ভরা কেবল মানুষ। দুই পাশের বাড়িগুলোর ছাদ পর্যন্ত মানুষ। গলি–উপ-গলি থেকে স্রোত এসে মিশে মূলধারার সঙ্গে, মানুষ বাড়ে; নাবাবপুর সামলাতে পারে না। ...ঢাকায় কি এত লোক বাস করে? মনে হয় ঢাকা শহর তার ৩৫০/৪০০ বছরের বুড়ো হাবড়া, রোগা পটকা লোনা-ধরা গতর ঝেড়ে উঠে ছুটতে শুরু করেছে সামনের দিকে। ...দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা তার শীর্ণ তনু একেবারে নিচে ফেলে উঠে এসেছে বিপুল স্ফীত হয়ে। বুড়িগঙ্গার অজস্র তরঙ্গরাশির সক্রিয় অংশগ্রহণ না হলে কি এমন জলদমন্দ্র ধ্বণি উঠতে পারে, ‘আসাদের রক্ত’-‘বৃথা যেতে দেব না’।”

পুরান ঢাকার হাজী ওসমান গণি রোডে পিচ্চিদের নিয়ে স্কুলপালানো ছেলেটা মিছিল বের করত। দশ-পনেরোটা ছেলে জুটিয়েও ফেলত। নাজিরাবাজার থেকে মিছিল নিয়ে চলে যেত আলুবাজার পর্যন্ত। কালো পতাকা নিয়ে মিছিল। ঢাকা হোটেল পর্যন্ত মিছিল নিয়ে গিয়ে সঙ্গীদের ফেরত পাঠিয়ে ছেলেটা মিশে যেত নবাবপুর রোডের মিছিলের জনস্রোতে । পুলিশের ওপর তাৎক্ষণিক ব্যবহারের জন্য হাফপ্যান্টের পকেটে মজুত আছে কিছু ইটের টুকরা। মিছিলে টিয়ার গ্যাস, গুলির শব্দ শুনলে দে ছুট। এমনি একদিন কোনো এক গুলি খাওয়া মিছিল থেকে বাড়ি ফিরে শুনল, নবকুমার ইনস্টিটিউটের এক ছাত্র পুলিশের গুলিতে মারা গেছে।

আজ বিকেলে মহল্লা থেকে মিছিল যাবে। কিন্তু সেই ছেলেটি কোথায়?
‘অই, দেখ তো আমাগো ভাসানী কই গ্যাছে। হেরে বুলা।’

কিন্তু খুঁজতে হলো না। রবাহূত হয়ে সে হাজির। হাতে কালো পতাকা। পতাকা দেখে কয়েকজন বলে উঠল—
‘আরে, আইজকা কালা ফেলেগ না। পাকিস্তানের ফেলেগ আন।’

অনেকগুলো পাকিস্তানি পতাকা নিয়ে মিছিল চলল। কে একজন ছেলেটাকে কাঁধে তুলে নিল। ‘সোলোগান দেও।’

মিছিল চলেছে রেসকোর্সে। ‘জেলের তালা ভেঙেছি, শেখ মুজিবকে এনেছি’।

সেই ছেলেটা ছিলাম আমি।

আসাদের মৃত্যুর পর যে উত্তাল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, তাতে অশান্ত হয়ে ওঠে কবি হেলাল হাফিজের কবিমন। তিনি লিখে ফেলেন বাংলা সাহিত্যের একটি অসাধারণ জনপ্রিয় এবং তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠতম কবিতা ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’।

এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
মিছিলের সব হাত
কন্ঠ
পা এক নয়।

যদি কেউ ভালোবেসে খুনী হতে চান
তাই হয়ে যান
উৎকৃষ্ট সময় কিন্তু আজ বয়ে যায়।

জানাজার পর আসাদের রক্তমাখা শার্ট নিয়ে মানুষের মিছিল, ২০ জানুয়ারি ১৯৬৯। ছবি: রশীদ তালুকদার
জানাজার পর আসাদের রক্তমাখা শার্ট নিয়ে মানুষের মিছিল, ২০ জানুয়ারি ১৯৬৯। ছবি: রশীদ তালুকদার

এ রকম সময় আমরা প্রায়ই সন্ধ্যার পর ছাদে উঠতাম আগুন দেখার জন্য।

ভাসানীর মিটিং থেকে বের হয়ে লোকজন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার জজের বাড়িতে আগুন দিয়েছে।

‘ওই হুনছস, মন্ত্রীগো বাড়ি, ছব বাড়ি জ্বালাইয়া দিতাছে।’

আমার মামা ঢাকা এলে আরজু হোটেলে উঠতেন। একদিন ছাদে উঠে দেখলাম মামার সেই হোটেল দাউ দাউ করে জ্বলছে।

কারফিউও ছিল এক খেলা। গলির মুখে গিয়ে উঁকিঝুঁকি না দিলেই নয়। ইপিআর তাড়া করলে দে দৌড়।

উনসত্তরের দুজন শহীদকে আল মাহমুদ তাঁর ‘ঊনসত্তরের ছড়া’ তে চমৎকারভাবে নিয়ে এসেছেন। এই ছড়া আমাকে দারুণভাবে আলোড়িত করে—

ট্রাক ট্রাক ট্রাক। শূয়োর মুখো ট্রাক আসবে
দুয়োর বেঁধে রাখ।
কেন বাঁধবো দোর জানালা তুলবো কেন খিল?
আসাদ গেছে মিছিল নিয়ে ফিরবে সে মিছিল।

ট্রাক ট্রাক ট্রাক। ট্রাকের মুখে আগুন দিতে মতিউরকে ডাক
কোথায় পাব মতিঊরকে ঘুমিয়ে আছে সে
তোরাই তবে সোনা মানিক আগুন জ্বেলে দে।

উনসত্তরের গণ-আন্দোলনের অসাধারণ চলচ্চিত্র জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’। ছবির বিজ্ঞাপনে লেখা হতো, ‘একটি দেশ, একটি সংসার, একটি চাবির গোছা, একটি আন্দোলন’। এই ছবিটি ১৯৭০ সালের এপ্রিলে মুক্তি পায়। আমার অগ্রজের সঙ্গে শৈশবের সেই সেই মিছিলে-যাওয়া উত্তাল দিনগুলোতেই গুলিস্তান সিনেমা হলে ছবিটি দেখেছিলাম। ছবি দেখে অনেক সময় দর্শকেরা স্লোগান দিতে দিতে বের হতো।

আজ আসাদ দিবসে শহীদ আসাদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই, যাঁর আত্মত্যাগ এ দেশের ইতিহাসের এক গৌরবজনক পর্বের সূচনা করেছিল।

চৌধুরী মুফাদ আহমদ, প্রাবন্ধিক
[email protected]