আমি যদি মেয়র হতাম, তাহলে অন্য সব গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের পাশাপাশি বুড়িগঙ্গা নদীকে স্বমহিমায় ফিরিয়ে আনার কথা বলতাম। কিন্তু তহবিল কোথায়? সিটি করপোরেশনের তো অত টাকা নেই। তাহলে? তার পরও একটা বুদ্ধি আছে। সে কথায় পরে আসছি।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মূল কয়েকজন মেয়র পদপ্রার্থী প্রথম আলোর গোলটেবিল বৈঠকে বেশ কিছু ব্যতিক্রমী কথা বলেছেন। তাঁদের কিছু চিন্তাভাবনা চমকপ্রদও। প্রচলিত ধ্যানধারণাকে হার মানায়। কিন্তু বুড়িগঙ্গা নদীর কথা কেউ বলেননি। অবশ্য নদীটি তো সিটি করপোরেশনের মধ্যে পড়ে না। সীমানা দিয়ে চলে গেছে। তাই এই নদীর ভালো-মন্দ যে সিটি করপোরেশনের দায়িত্বের আওতায় আসতে পারে, সেটা কারও ভাবনার মধ্যেই নেই। অথচ ঢাকা মহানগর বলি বা রাজধানী ঢাকা বলি, অবিভক্ত উত্তর-দক্ষিণ হিসেবে দেখলে বিষয়টি ঢাকা মহানগরবাসীর জীবন-মরণের প্রশ্ন। বুড়িগঙ্গা বাদ দিয়ে কি ঢাকাবাসীর মঙ্গলের কথা ভাবা যায়?
আমাদের গোলটেবিলে মেয়র প্রার্থীদের একটা কথা খুব ভালো বলতেই হবে। ছয়জন মেয়র প্রার্থীর সবাই বলেছেন, তাঁরা যদি মেয়র নির্বাচিত হন, তাহলে সিটি করপোরেশনকে দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখবেন। প্রত্যেক প্রার্থীর পেছনেই কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের সমর্থন রয়েছে। কেউ কেউ প্রধান রাজনৈতিক কোনো দলের প্রথম বা অন্তত মধ্যম সারির নেতা। তাঁরা যখন সিটি করপোরেশনকে দলীয় সংকীর্ণ রাজনীতির বাইরে রাখার কথা বলেন এবং যদি নির্বাচিত হয়ে সত্যিই তা বাস্তবায়ন করেন, তাহলে বলতে হবে একটা বিপ্লব হয়ে যাবে। কপাল খুলে যাবে রাজধানীর মানুষের।
এর মানে এই নয় যে রাজনীতিই সব নষ্টের গোড়া। তা নয়। দেশ নিশ্চয়ই রাজনীতিকেরা চালাবেন। কিন্তু স্থানীয় সরকার? এর প্রধান কাজ হলো নাগরিক সেবা নিশ্চিত করা। সেখানে দলীয় রাজনীতি টেনে আনার কুফল গত কয়েক দশকে আমরা কম দেখিনি।
বলা হয়, সিটি করপোরেশনের হাতে খুব বেশি ক্ষমতা নেই। সেটা ঠিক। পানির দায়িত্ব ওয়াসার, বিদ্যুতের জন্য রয়েছে আলাদা বিভাগ। তিতাস গ্যাস তো আর সিটি করপোরেশনের কথা শুনে চলবে না। তাহলে নাগরিকেরা যখন পানি পায় না, বিদ্যুৎ বা গ্যাস-সংকটে ভোগে, তখন সিটি করপোরেশনের কাছে হাত পেতে তো ফল পাবে না। এটা ঠিক।
কিন্তু তার পরও সিটি করপোরেশনের হাতে একটা মোক্ষম ক্ষমতা আছে। সেটা টেন্ডারের ক্ষমতা। এই ক্ষমতার দৌরাত্ম্য বোঝা যায় যখন সামান্য কিছু রাস্তা তৈরি বা সংস্কার, অথবা দোকান বরাদ্দ, মার্কেট ইজারা বা এ ধরনের কাজের জন্য টেন্ডারবাজি শুরু হয়। সিটি করপোরেশন কার্যালয়ে টেন্ডারবাজি কম হয়নি। এমনকি টেন্ডার নিয়ে গোলাগুলিও হয়েছে। বিচার হয়নি। কারণ একটাই। সেই দলবাজি।
তাই আজ যে প্রার্থীরা বলে গেলেন, তাঁরা মেয়র নির্বাচিত হলে করপোরেশনে দলীয় রাজনীতি ঢুকতে দেবেন না, সেটা যদি সত্যি সত্যি তাঁরা বাস্তবায়ন করেন, তাহলে টেন্ডারবাজি নিয়ে খুনোখুনি নিয়ন্ত্রণ অনেক সহজ হবে। দুর্নীতির গোড়ায়ও ধাক্কা লাগবে। একটা পরিবর্তনের সুবাতাস বইতে পারে।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কথা অনেকেই বলে গেছেন। প্রায় সবাই বলেছেন নগরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার কথা। দুজন প্রার্থী তো ঝাড়ু-বেলচা নিয়ে রাজপথ পরিষ্কারে ইতিমধ্যে নেমে গেছেন। নমুনা হিসেবে। এটা ভালো উদ্যোগ। কিন্তু সমস্যার বহর তো কম নয়। শুধু ঝাড়ু-বেলচায় সামলানো যাবে না। ঢাকা মহানগরে দেড় কোটির বেশি মানুষ। মনুষ্য বর্জ্যত্যাগের কথা না হয় বাদই দিলাম। বস্তি এলাকায় সে তো এক জঘন্য সমস্যা। এর বাইরে প্রতিদিনের গৃহস্থালি বর্জ্য যদি জনপ্রতি মাত্র এক কেজিও ধরি, তাহলে প্রতিদিন অন্তত দেড় কোটি কেজি, অর্থাৎ ১৫ হাজার টন বর্জ্য জমা হচ্ছে। সারা শহরে এসব বর্জ্য ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থেকে পরিবেশ দুর্বিষহ করে তোলে। এই মহানগর যে শুধু যানজট, ছিনতাই-রাহাজানি, ভেজাল খাবার, ঠগবাজ, বখাটেপনার জন্যই বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠেছে, তাই নয়। যেখানে-সেখানে বর্জ্যের ছড়াছড়িও একটা কারণ।
এই বর্জ্য সিটি করপোরেশন ফেলবে কোথায়? আমরা একটা আধুনিক ব্যবস্থার কথা ভাবতে পারি। এই বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ তৈরি করব, জৈব সার তৈরি করব। জার্মানি, ডেনমার্ক শহরে দেখে এসেছি কী সুন্দর শহর। সুন্দর, কারণ ওরা বর্জ্য থেকে শক্তি ও সার তৈরি করছে। প্ল্যান্ট বসিয়েছে। ওরা কোনো জিনিসই নষ্ট হতে দেয় না। এমনকি ময়লাও নষ্ট হয় না। কাজে লাগায়। আমাদের মেয়ররা ভবিষ্যতে বর্জ্যকে শক্তিতে রূপান্তরিত করে রাজধানী ঢাকায় এক নতুন যুগের সূচনা করবেন বলে আশা করি।
দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় পর মেয়র নির্বাচন হচ্ছে। শেষ তিন-চার বছর ধরে তো ঢাকায় কোনো নির্বাচিত মেয়রই নেই। চলছে প্রশাসকের আদেশ-নির্দেশে। তাই মেয়র নির্বাচন এখন খুব আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। মানুষ নিশ্চয়ই দলে দলে ভোট দিতে আসবে। কারণ, তাদের দরকার সহজে নাগরিক সেবা লাভের সুবিধা। প্রায় সব প্রার্থীই বলেছেন নাগরিকদের প্রাপ্য সেবা নিশ্চিত করাই হবে তাঁদের প্রধান কাজ। এখন তো নাগরিকত্ব সনদ নিতেও অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। নির্বাচিত মেয়র ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর থাকলে সহজে এসব সেবা পাওয়া যাবে। একজন নির্বাচিত মেয়র খুব সহজে মানুষের কাছাকাছি যেতে পারবেন, যদি তিনি রুটিন করে প্রতি সপ্তাহে একটি করে ওয়ার্ড টহলে বেরোন। যেখানে রাস্তা ভাঙাচোরা দেখবেন, অথবা ময়লার পাহাড়, সঙ্গে সঙ্গে সেখানে দায়িত্ব পালনকারীকে তলব করে জবাবদিহি করলে মানুষ চোখের সামনে প্রতিকারের একটা উপায় খুঁজে পাবে। এ দেশে জবাবদিহির বালাই নেই। সেখানে নতুন মেয়র নির্বাচিত হয়ে এসে যদি নতুন পথের সন্ধান দেন, তাহলে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
এখন আসি সেই বুড়িগঙ্গার কথায়।
আমি মেয়র প্রার্থী না। কিন্তু অনেক সময় ভাবি, যদি মেয়র হতাম, তাহলে অন্য সব জরুরি কাজগুলো তো করতামই। যেমন অন্যরা বলেছেন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, যানজট নিরসন, নারীবান্ধব পরিবেশ, এ প্রজন্মের জন্য এক নতুন মহানগর গড়ে তোলা, সেসব তো করতামই। কিন্তু সেখানেই থেমে থাকতাম না।
এর বাইরে আমি ভাবতাম আমাদের এই রাজধানীর কোল ঘেঁষে বয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গা নদীর কথা। এ পর্যন্ত কোনো মেয়র প্রার্থীই এই দায়িত্বের কথা বলেননি। অথচ এই বুড়িগঙ্গাই আমাদের এই মহানগরের প্রাণ। সৌন্দর্য। ঐতিহ্য। আরও কত কী। এই নদীর অবস্থা আজ কী?
বুড়িগঙ্গা আজ মরতে বসেছে। যারা ধান্দাবাজ, তারা তো মারছেই। এমনকি সরকারি লোকজনও এই নদীকে মারছে নানাভাবে। নদীর পানি দূষণ করছে শত শত কারখানা। তারা দূষিত তরল, রং, এমনকি রাসায়নিক দ্রব্য, সবকিছু পাইপ দিয়ে নদীর পানিতে ঢালছে। নদীর পাড় দখল করে গড়ে তুলছে বালুমহাল। তারা প্রভাবশালী। বাধা দেওয়ার কেউ নেই। যাঁদের দেখার কথা, তাঁরা কিছুমিছু খেয়ে ছেড়ে দেন। মাঝেমধ্যে বুড়িগঙ্গার তীরের অবৈধ স্থাপনা ভাঙা হয় বটে, কিন্তু আবার গজায়।
বুড়িগঙ্গার পানি আজ কালো হয়ে গেছে। নৌবিহারে যাবেন, তার উপায় নেই। দুর্গন্ধে প্রাণ ওষ্ঠাগত। পানিতে কোনো মাছ নেই। কারণ, রাসায়নিক দ্রব্যে পানি বিষাক্ত। বুড়িগঙ্গার তীরে আজ আমরা বেড়াতে যাই না। এই নদী আমাদের দূরে ঠেলে দেয়।
আমরা কি পারি না বুড়িগঙ্গাকে বাঁচাতে? নিশ্চয়ই পারি। বেইজিংয়ে দেখেছি নগরের মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে বুড়িগঙ্গার এক-তৃতীয়াংশ বহরের শীর্ণকায় এক নদী। এরই দুই পাড় কী সুন্দর করে বাঁধিয়ে রেখেছেন নগরবিদেরা। পানি স্বচ্ছ। সকালে মানুষ দুই পাশের ওয়াকওয়ে দিয়ে হাঁটে। নদীর পাড় ঘেঁষে রয়েছে পার্ক। শুধু বেইজিং কেন? কোথায় নেই? বিশ্বের সবচেয়ে ব্যস্ত নগর নিউইয়র্কে রয়েছে হাডসন নদী। সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমের বুক চিড়ে বয়ে গেছে কী সুন্দর যত্নে লালিত নদী। লন্ডনের টেমস নদীর কথা নতুন করে আর না-ই বা বললাম।
তাহলে আমরা পারব না কেন। বুড়িগঙ্গা নদীটি ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ-দুই সিটি করপোরেশনেরই কূল ঘেঁষে বয়ে গেছে। তাই আগামী দিনে নির্বাচিত দুই মেয়র মিলে বুড়িগঙ্গা নদীকে স্বমহিমায় ফিরিয়ে আনার একটি প্রকল্প নিতে পারেন। এটা হবে এক মেগা প্রকল্প। এর জন্য চাই মেগা তহবিল। সরকার তো কিছু দেবেই। কিন্তু এই প্রকল্পের জন্য ‘ক্রাউড ফান্ডিং’-এর উদ্যোগ নিলে তহবিলের সমস্যা অনেকটা কাটিয়ে ওঠা যাবে। সাধারণ নাগরিকেরা শেয়ার কিনবেন। প্রবাসীদের প্রতি আহ্বান জানালে তাঁরাও উদার মনে এগিয়ে আসবেন। কঠোর নজরদারিতে রাখা হবে বুড়িগঙ্গার চারপাশ। কোনো কারখানার বর্জ্য অপরিশোধিত অবস্থায় নদীতে ফেলা যাবে না। তরল বর্জ্য পরিশোধন যন্ত্র ব্যবহার করতে হবে। বাধ্যতামূলক। ঢাকার চারপাশ দিয়ে যে চারটি নদী বয়ে গেছে, সেগুলোও একইভাবে সুন্দর স্রোতোধারায় রূপান্তরিত করতে হবে। চারপাশের নদীপথে চলবে নৌযান। এ পরিকল্পনা এখনো আছে, কিন্তু নদীই যেখানে মরছে, ট্রলার চলবে কোথায়?
প্রশ্ন হলো, ক্রাউড ফান্ডিংয়ে কে আসবে? ঢাকার মানুষই আসবে। কারণ, তারা জানে বুড়িগঙ্গা বাঁচলে ঢাকা বাঁচবে। আমাদের ঐতিহ্য বাঁচবে।
আগামী দিনের নির্বাচিত মেয়ররা এ রকম একটা সাহসী পদক্ষেপ নিলে এ যুগের নতুন প্রজন্মের কাছে তাঁরা স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
[email protected]