'আমরা কূপে পড়ে গিয়েছি'

জিহাদ
জিহাদ

প্রথম আলোর একজন পাঠক ২৭ ডিসেম্বর শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনির মাঠে নলকূপের খোলা পাইপে পড়ে গিয়ে হতভাগ্য শিশু জিহাদের মৃত্যু নিয়ে একটি অতি সং‌িক্ষপ্ত মন্তব্য করেছেন পরদিন অনলাইনে। মন্তব্যটি ছিল: আমরা কুয়ায় পড়ে গেছি।
শাহজাহানপুরের মর্মা‌িন্তক ঘটনাটি রানা প্লাজা ধস বা তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডের তুলনায় কিছুই নয়, কিন্তু ব্যাপ্তি ও তাৎপর্যে এতই ব্যাপক যে এই ভূখণ্ডের ১৬ কোটি মানুষ যে রাষ্ট্রযন্ত্রের হাতে উন্মূল, অসহায়—ঘটনাটি যেন তারই বিশদ ও প্রায়-পুঙ্খানুপুঙ্খ সচিত্র বয়ান। পাঠক যে মন্তব্যটি করেছেন, তা শুধু লাগসই-ই নয়; মাত্র তিনটি শব্দে গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থার শিকড়-বাকড় ধরে টান দিয়েছেন। হ্যাঁ, আমরা তীব্র তিমিরাচ্ছন্ন কূপে পতিত হয়েছি এবং এ ঘটনার পর মনে হচ্ছে, নি‌িক্ষপ্ত হয়েছি। সর্বশক্তি দিয়েও রাষ্ট্রযন্ত্রের সাধ্য নেই আমাদের জীবিত, মুমূর্ষু বা মৃত—কোনো অবস্থায়ই টেনে তোলে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, রাষ্ট্রকে তার আহরিত শক্তিতে বলীয়ান হতে হয়। সে জন্য ইংরেজি স্টেট মেশিনারি কথাটির আক্ষরিক অর্থ বাংলায় জুতসইভাবেই রাষ্ট্রযন্ত্র। রাষ্ট্রকে সেই শক্তি আহরণ করতে হয় তার নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সক্ষমতাকে একত্রে ধারণ করে। রাষ্ট্র তখনই হীনবল, যখন সে শক্তির জোগান পায় না, অথবা শক্তির উৎসগুলোকে প্রবহমান করতে ব্যর্থ হয়, অথবা তা করতে আদৌ সচেষ্ট থাকে না। এখানে যে প্রশ্নটি অবধারিত তা হলো, রাষ্ট্র কেন স্বেচ্ছায় তার কাঙ্ক্ষিত শক্তির জায়গায় নিজেকে দাঁড় করাবে না? জবাব খোঁজার আগে মৌল বিষয়টির দিকে নজর দিতে হবে। রাষ্ট্র যাঁরা চালান, তাঁদের জানতে হবে শক্তির উৎসগুলো কোথায়? পেশিতে? অস্বীকার করার উপায় নেই, প্রয়োজনবোধে রাষ্ট্রকে অবশ্যই পেশিশক্তিতে বলীয়ান হতে হয়। কিন্তু পেশির বাইরে মগজ-মেধাও যে শক্তির অন্যতম জোগানদাতা, তা যদি পেশি সঞ্চালনের গরিমায় রাষ্ট্র তোয়াক্কাই না করে, তাহলে যা হওয়ার তা-ই হয়। যেমন হয়েছে দীর্ঘ ২৩ ঘণ্টাব্যাপী পণ্ডশ্রমে; সেই সঙ্গে দেশবাসীর মনে এই নিখাদ সত্যটি প্রতিষ্ঠিত করে যে শিশু জিহাদের মতো তারাও এই রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে কিছু প্রত্যাশা করতে পারে না—কর্তব্য পালনের কিছু আচার-অনুষ্ঠান ছাড়া। বরং বিনিময়ে জুটতে পারে দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য, সঙ্গে হয়রানিও।
দীর্ঘ ২৩ ঘণ্টার যে রুদ্ধশ্বাস কর্মকাণ্ড দেশবাসী টেলিভিশনের পর্দায় দেখল, তা এককথায় গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থারই একটি প্রতীকী চিত্র। গল্প-উপন্যাসের মাথা খাটানো, ইঙ্গিতপ্রবণ প্রতীক নয়—খোলামেলা, বিস্তৃত অঙ্গসজ্জায় একটি বিপুল শাখা-প্রশাখাময় প্রতীক। দুর্ঘটনায় পতিত অবোধ শিশুটিকে প্রাণে বাঁচানো যেত কি না, সে প্রশ্নে না গিয়ে দেশবাসীর কাছে এটা তো জ্বলজ্বলে পরিষ্কার যে ঘটনাটি ঘটে যাওয়ার পর থেকে নীতিনির্ধারক থেকে শুরু করে বিশাল কর্মী বাহিনী—সবাই মিলে একটি সমন্বিত ও কার্যকর পরিকল্পনায় উপনীত হওয়ার মতো পরিপক্বতার লক্ষণ দেখা যায়নি। আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা সংগত নয়। কিন্তু আন্তরিকতার সঙ্গে যা ওতপ্রোতভাবে জড়িত, সেই পেশাগত জ্ঞান ও দুর্যোগ মোকাবিলার দৃঢ়তার ঘাটতি যদি থাকে, তাহলে ওয়াসার বিখ্যাত ক্যামেরার মনিটর চালু করতে চার-পাঁচ ঘণ্টা সময় লাগবে, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আর গভীর পাইপে শেষ পর্যন্ত ক্যামেরা ঢুকিয়ে পোকামাকড় পাওয়া গেলেও শিশুটির সন্ধান মিলল না বলে অপারেশনের ইতি ঘোষণা দেওয়া তাঁদেরই সাজে, যাঁরা কেবল কর্তব্য পালনেই নিয়োজিত হয়েছিলেন।
এর বিপরীত চিত্রটিই যা বাঁচোয়া। সাধারণ স্বেচ্ছাসেবীরা দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে এসেছেন—কর্তব্য পালনের জন্য নয়, এসেছেন দায়িত্ব পালনের টানে। কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনের তফাতটা এখানেই। নিরলস পরিশ্রমে রাতভর চেষ্টায় নিজেদের উদ্ভাবিত লোহার শিকের আংটায় শিশুটিকে বের করে তঁারা প্রমাণ করলেন—শিশুটির পতন কোনো গুঞ্জন-রটনা নয়, রাজনীতির ভেলকিবাজিও নয়।
দেশবাসী হতভম্ব হয়ে সাধারণ মানুষের অনন্যসাধারণ কীর্তিটি দেখল আর বুকভাঙা হতাশা নিয়ে এ-ও উপলব্ধি করল, শিশুটিকে নিজের নিথর শরীর দিনের আলোয় মেলে ধরে প্রমাণ করতে হলো, সে সত্যিই প্রাণঘাতী লোহার কূপে পড়ে তলিয়ে গিয়েছিল। তলিয়েই সে থাকত অতল অন্ধকারে, গুঞ্জন-রটনা জিতে যেত, আরও পল্লবিত হতো, হয়তো খোঁজ চলত ষড়যন্ত্রের—যদি কয়েকজন অদম্য মানুষ হাল ছেড়ে দিতেন।
দেশবাসী কূপে পড়ে গিয়েছে—এ অনুভূতির বিকল্প ভাবনা খোঁজা মুশকিল। রাষ্ট্রযন্ত্রের সামর্থ্য নেই টেনে তুলবে, তবে যাদের মুখ চেয়ে আশার আকুতি জাগতে পারে, তারা আছে। অত্যাশ্চর্য হলেও ভরসা এই—তারা আছে।
ওয়াসি আহমেদ: কথাসাহিত্যিক।