২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

'আদর্শ হাউসওয়াইফ' হতেই হবে?

সুমাইয়া বেগমকে সমাবর্তনের হ্যাট পরিয়ে দেন এক সহপাঠী। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে। ছবি: সংগৃহীত
সুমাইয়া বেগমকে সমাবর্তনের হ্যাট পরিয়ে দেন এক সহপাঠী। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে। ছবি: সংগৃহীত

সাবেক বা বর্তমান শিক্ষার্থীদের ছবি ফেসবুকে ভেসে এলেই স্নেহ ও ভালোবাসার কারণেই দেখি। আর এই সময়ে তো আরও বেশি মনে পড়ে শিক্ষার্থীদের কথা। গতকাল রাতও তেমন ছিল, আমার হলের আবাসিক ছাত্রী সুমাইয়া বেগমের ছবিটি ভেসে এসেছিল খাদিজা শারমীন অন্তরার ফেসবুক আইডি থেকে। এরা দুজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের আবাসিক ছাত্রী, আর আমি এই হলের আবাসিক শিক্ষকদের একজন। সুমাইয়ার ছবিটি দেখেই নিচে অন্তরার লেখাটি পড়তে গিয়ে জানলাম, আমাদের সুমাইয়া আর নেই।

সুমাইয়া বেগম ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্রী ছিল। এ বছরই তার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়ার কথা। কিন্তু তা আর হয়নি। মেয়েটি নেই আর এই পৃথিবীতে। তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাকে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ তার পরিবারের। আজ হয়তো সবকিছু স্বাভাবিক থাকলে রাস্তায় বের হয়ে প্রিয় ছাত্রী হত্যার বিচার চাইত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার।

কেন সুমাইয়াকে প্রাণ দিতে হলো? কারণ, সুমাইয়ার শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়রা চায়নি সুমাইয়া পড়াশোনা শেষ করুক। শুধু তা-ই নয়, তার চাকরি করার অদম্য ইচ্ছাটিকেও তিল তিল করে পিষে ফেলার চেষ্টা করেছে তারা।
বিষয়টি আমি কিছুটা জানতাম। গত বছরের শেষের দিকে এক সন্ধ্যায় সুমাইয়া আমাকে ফোন করে এবং জানায়, সে আমার সঙ্গে কিছু বিষয় নিয়ে আলাপ করতে চায়। যথারীতি সেদিন ডিউটি আওয়ারেই মাথায় সব সময় মাথায় ওড়না দেওয়া সুমাইয়া আমাদের হল অফিস রুমে এল। খুব আস্তে আস্তে কথা বলছিল। জানাল, কিছুদিন আগেই তার বাবা মারা গেছেন। তার পরিবার খুবই রক্ষণশীল, কিন্তু তার বাবা চাইতেন, সে যেন চাকরি করে।

খুবই মলিন মুখে সুমাইয়া জানায়, তার বাবা মারা যাওয়ায় সে খুবই খারাপ অবস্থায় আছে। সে কিছু একটা করতে চায়, আমি কোনোভাবে তাকে সহায়তা করতে পারি কি না। আমার কোনো গবেষণাকাজে সে সহায়তা করতে পারে কি না। অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী সে। যা বলছে, খুব দৃঢ়তার সঙ্গে স্পষ্টভাবে বলছে। কোথাও দ্বিধা নেই, জড়তা নেই, আমতা-আমতা নেই। ধর্মীয়ভাবে রক্ষণশীল কিন্তু কাজ করা, নিজের মতো জীবন যাপন করার অধিকারের বিষয়ে দুর্দমনীয়, বলিষ্ঠ। মেয়েটির জীবনবোধের ধার আমাকে স্পর্শ করে, কোথায় যেন ছুঁয়ে যায়।

তার আগ্রহের বিপরীতে আমি জানালাম, আমাদের কাজে ঢাকার বাইরে ফিল্ডওয়ার্কে যেতে হয়, এবং সে যেতে রাজি আছে কি না। ও তখন বলল, তার সমস্যা নেই কিন্তু তার যার সঙ্গে সম্পর্ক, সে রাজি হবে না। আরও জানাল, সে শুধু ঢাকার বাইরে নয়, ছেলেটা কোনো ধরনের চাকরি করার ক্ষেত্রে রাজি নয়। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, সে ছেলেটিকে রাজি করাতে চেষ্টা করেছে অনেক, কিন্তু কিছুতেই পারছে না। সে খুব অসহায় বোধ করছে। সেই মুহূর্তে সুমাইয়াকে বললাম, ঢাকায় কোনো কাজ থাকলে বলব। এরপর আরও একদিন দেখেছিলাম সুমাইয়াকে নিচতলার স্টাডি রুমে পড়তে।

সুমাইয়া হলের ৩০৮ নম্বর রুমে থাকত। খুব সম্ভব এ বছরের প্রথম দিকেই সে হল ছেড়ে আজিমপুরে কোনো এক বাসায় সাবলেট হিসেবে উঠেছিল সংসার শুরু করার স্বপ্ন নিয়ে। তার রুমমেট এবং অন্যদের থেকে শুনেছি, ৪০ দিন আগে ওর ছয় মাসের বাচ্চা মিসক্যারেজ হয় এবং সে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। সে মায়ের কাছেই ছিল। কিন্তু সুমাইয়ার শ্বশুরবাড়ির লোকদের সঙ্গে তাদের সমস্যা শুরু হলে সেদিন নিজেই শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিল মায়ের বারণ সত্ত্বেও। ভেবেছিল কিছুটা দেনদরবার করতে পারবে। কিন্তু তার নিজের জীবনের দফারফাই হয়ে গেল। যেদিন গেল সেই রাতেই সে মারা গেল। বন্ধুরা বলছে, শ্বশুরবাড়ির আবদার ‘সুমাইয়াকে ভালো হাউসওয়াইফ’ হতে হবে। সেটি হতে হলে চাকরি করা যাবে না। কিন্তু সুমাইয়ার মধ্যে কিছু একটা করার যে হিম্মত আমি দেখেছি, তাতে তার সায় দেওয়ার কথা নয়। তাতেই জীবন নিভে গেল মেয়েটির।

শুধু সুমাইয়াই নয়, এ দেশে এখনো অসংখ্য উচ্চশিক্ষিত নারীকে প্রাণ দিতে হয়, মেনে নিয়ে ভালো থাকার চেষ্টায় অবিরাম অনুশীলন করতে হয় শুধু পরিবারের ‘আদর্শ বউ’ হওয়ার হাউসটি পূর্ণ করার জন্য। ছয় বছর আগে একটি গবেষণায় পেয়েছিলাম যে বাংলাদেশ প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়া নারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৩২% শুধু পরিবার ও সমাজের কাছে কাঙ্ক্ষিত ‘আদর্শ গৃহবধূ’ হওয়ার ইচ্ছা বাস্তবায়নের জন্য শ্রমবাজারে প্রবেশ করতে পারে না। তারা মন নিয়ে নয়, মেনে নিয়ে ভালো থাকার চেষ্টা করে কিংবা অনেকেরই হয়তো সুমাইয়ার মতো করুণ পরিণতি হয়।

উচ্চশিক্ষা গ্রহণ, চাকরিতে প্রবেশ কিংবা চাকরি নির্বাচনের ক্ষমতা এখন পর্যন্ত অনেকাংশেই স্বীকৃত নয় নারীর জন্য। সুমাইয়া কি তবে আগেই বুঝতে পেরেছিল তার এই পরিণতির কথা? তাই তো সাহস ও উৎসাহ চেয়েছিল। পরিবারের বেশ কিছুটা অমতেই ভালোবেসে বিয়ে করেছিল সে, কিন্তু আস্তে আস্তে থেমে গিয়েছিল অনেক কিছুই। শেষে জীবনটাই।

সুমাইয়ার মৃত্যু আরও বেশি মনে করাচ্ছে শেষবার দেখা হার না মানা প্রত্যয়ের মেজাজটিকে। আসলে সুমাইয়ারা হারে না, হেরে যাই আমরা, যারা কোনোভাবেই থামাতে পারছি না সুমাইয়াদের চলে যাওয়া।
এই হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত চাই, বিচার চাই।