মানুষ মারলে কথা হয় না, কথা হয় বাস পোড়ালে! সড়কে কাঠামোগত নৈরাজ্যের ফলে অপমৃত্যুর ঘটনাকে ঢেকে ফেলা হয় ‘দুর্ঘটনা’ শব্দ দিয়ে। সেই দুর্ঘটনায় এই নভেম্বর মাসেই ৫৪ শিক্ষার্থীর প্রাণ ঝরেছে। যে স্কুল-কলেজের কেউ মারা যায়, সেখানকার সবাই শোকের ধাক্কা খায়। যে এলাকার কেউ মারা যায়, ক্ষোভের তরঙ্গ সেই এলাকার ওপর দিয়ে বয়ে যায়। দেশবাসীর মনেও জমে অসহায় রাগ। মৃতের সহপাঠীরা আন্দোলনে না নামলে, এলাকাবাসী রাস্তা অবরোধ না করলে কর্তৃপক্ষের সমস্যা হয় না। সমস্যা হয় ন্যায়বিচার দাবি করে বসলে।
এবারও স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা আন্দোলনে না নামলে কর্তৃপক্ষ সাড়াশব্দটিও করত না। ২০১৮ সালের কিশোর আন্দোলনের পর তো সে রকমভাবে কথা ওঠেনি। সড়কের দানব সমগ্র জাতির থেকেই প্রাণ হরণ করে। আমার তরুণবেলার বন্ধু টোকন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিল। ওর কথা আমাদের বন্ধুরা মনে রেখেছে। আমার চিকিৎসক বন্ধু মিঠু পরিণত যৌবনে সপরিবার নিহত হন, তিনটি সন্তানের একটি কোনোভাবে বেঁচে যায়। তাঁর ও তাঁর মেয়েটির কথাও আমরা ভুলিনি। এখন শিক্ষার্থীদের আর্তনাদ কানে বেশি বাজছে। কারণ, তারা মৃত বন্ধুর যন্ত্রণার প্রতিধ্বনি করেই যাচ্ছে। কারণ, এ ধরনের মৃত্যু তাদের কাছে দূরের সম্ভাবনা নয়, এটা তাদের ঘনিষ্ঠ আশঙ্কা। এ বছরের জানুয়ারি মাসেই মারা গেছে ৭৯ শিক্ষার্থী। গত ১১ মাসে সড়কে পিষ্ট হয়ে মারা গেছেন ৫ হাজার ১৪৪ জন। তাঁদের মধ্যে শিক্ষার্থী ছিলেন ৭৩৭ জন।
এভাবে মৃত্যুর পরিসংখ্যান হয়ে যাওয়ার ভয় নিয়ে যাঁদের বাসে-লেগুনায় চড়তে হয়, তাঁরা নিরুপায় হয়ে বাঁচার দাবি তুলবেনই। গণদাবিকে চ্যালেঞ্জ বোধ করা সরকারের কাজ নয়। তাদের কাজ সহমর্মী হয়ে প্রতিকারের জন্য কাজ করা। কিন্তু তারা বাস কোম্পানিগুলোকে কিছু বলবে না, বিআরটিএ নামক সরকারি প্রতিষ্ঠানটিকে ঠিক করবে না, ইচ্ছেমতো ভাড়া বাড়ানোকে যৌক্তিকতা দিতে থাকবে, কিন্তু রাস্তায় মানুষ নামলেই বলবে, ষড়যন্ত্র হচ্ছে। তারা শিক্ষার্থীদের মিছিল ঘিরতে শত শত পুলিশ পাঠায়, কিন্তু মাসখানেকের জন্য প্রতিটি বাসে একজন করে পুলিশ দিলেও পরিস্থিতি অনেক বদলাত।
সাধারণ মানুষের স্তরে বসে দেখলে ‘কর্তৃপক্ষ’ দেখতে পেত, বাংলাদেশে সড়ক হলো নাগরিক নিপীড়নের কারখানা। এটা সময় খেয়ে নেয়, স্বাস্থ্য খেয়ে নেয়, উপার্জন খেয়ে নেয়, সম্মান খেয়ে নেয়; এমনকি জীবনও খেয়ে নেয়। কোন দুঃখে বাচ্চারা রাস্তায়, তা যদি তারা বুঝত, তাহলে কয়েকটি গাড়ির ক্ষতিকে অজস্র মর্মান্তিক মৃত্যুর চেয়ে বড় করে দেখত না।
পরিস্থিতি আরও করুণ ও কঠিন। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা দেখেছে যে ঢাকার ৭১ শতাংশ মানুষ নগরজীবনের চাপে বিষণ্ন। তারা এর পেছনে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার পেরেশানি ও বৈষম্যকে কারণ হিসেবে পেয়েছে। এটা সেই উন্নয়নের রাজধানী, যেখানকার ৮২ ভাগ তরুণ দেশে ভবিষ্যৎ দেখতে পান না। করোনার সময়ে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিষণ্নতা, হতাশা ও রাগও বাড়ছে। সমাজ হয়ে উঠছে মাইনফিল্ড। আজ এখানে, কাল ওখানে; আজ এ নিয়ে, কাল ও নিয়ে ক্ষোভের বিস্ফোরণ হচ্ছে। বিষণ্নতার শহরে তারুণ্যের রাগকে হিসাবে নিলে সরকারেরও ভালো হয়, মানুষও একটু শান্তি পায়।
এ রকম পরিস্থিতিতে পাড়ার নিরীহ কিশোরটির মাথা বাসের চাকায় গোলমরিচের মতো পিষে গেলে কীভাবে উদাস থাকতে হয়, কোনো মোটিভেশনাল স্পিকার তো তা আমাদের শেখায়নি। বরং আমরা শিখেছি, না কাঁদলে বাচ্চাও মায়ের দুধ পায় না। তাই তারা বাসে আগুন দেয়, ভাঙচুর করে, রাস্তায় বসে থাকে, যদি কর্তৃপক্ষের টনকের অবশ অঙ্গটি একটু নড়ে ওঠে! টনক অবশ্য নড়ে, কিন্তু সমাধানের জন্য নয়। টনকের ঘণ্টা বরং শাস্তির হুমকি বাজায়। কিন্তু এই কথার উত্তর তারা দেয় না, নভেম্বর মাসেই ৫৩ শিক্ষার্থী মারা যাওয়ার পরও কেন তারা গাঁট হয়ে বসে ছিল! ৫৪তম ঘটনায় যেই ছাত্ররা জেগে উঠল, অমনি সজাগ হলো? ৭৩৭টি তরুণ প্রাণের চেয়ে কয়েকটি বাসের মূল্য বেশি হয়ে গেল! নাকি যেভাবে বাসমালিকেরা চাপ দিয়ে ভাড়া বাড়িয়ে নিয়েছিলেন, এবারও তাদের কাঠি নাড়ানিতে সরকার নড়ে উঠল?
অবশ্যই বাস পোড়ানো বা ভাঙচুর করা শিক্ষার্থীদের কাজ নয়। কোনো নাগরিককেই এ ব্যাপারে উৎসাহিত করার কিছু নেই। হত্যার জবাবে হত্যা যেমন সমাধান নয়, তেমনি দায়িত্বহীন সড়ক প্রশাসনকে শিক্ষা দিতে বাসে আগুন দেওয়াও নিয়মতান্ত্রিক পথ নয়। পুলিশ-প্রশাসনের যে দৃষ্টিভঙ্গি, তাতে শৃঙ্খলা ভাঙার শাস্তি আছে। সেটাই তাদের কাজ। আমরা চাইব একই আন্তরিকতা নিয়ে তারা সড়কে নৈরাজ্যের জন্য দায়ী বাস কোম্পানিগুলোকেও শায়েস্তা করবে। পুলিশের কাজ পুলিশ করবে কিন্তু বিক্ষুব্ধ, স্বজনহারানো, ভুক্তভোগী এলাকাবাসীর মনের কান্নাটা শুনতে হবে সরকারকে। প্রতিটি উঠতি প্রাণ মানেই বিপুল সম্ভাবনা। সেই সম্ভাবনাময় প্রাণ মুনাফা আর দুর্নীতি-অযোগ্যতার কাছে অকাতরে বলি হতে পারে না। একজন ছাত্রের মৃত্যুকে মানুষ কেবল একজন ছাত্রের মৃত্যু হিসেবে দেখে না, তার মধ্যে দেখে নিজের সন্তানেরও মৃত্যুর হুমকি।
সাধারণ মানুষের স্তরে বসে দেখলে ‘কর্তৃপক্ষ’ দেখতে পেত, বাংলাদেশে সড়ক হলো নাগরিক নিপীড়নের কারখানা। এটা সময় খেয়ে নেয়, স্বাস্থ্য খেয়ে নেয়, উপার্জন খেয়ে নেয়, সম্মান খেয়ে নেয়; এমনকি জীবনও খেয়ে নেয়। কোন দুঃখে বাচ্চারা রাস্তায়, তা যদি তারা বুঝত, তাহলে কয়েকটি গাড়ির ক্ষতিকে অজস্র মর্মান্তিক মৃত্যুর চেয়ে বড় করে দেখত না। যদি সেই মানবিক দৃষ্টি তাদের থাকত, তাহলে হুঁশিয়ারিটা দায়িত্বহীন প্রশাসন ও বেপরোয়া পরিবহন মালিক সমিতির দিকে ছুড়ে দিত, স্বজন হারানোদের কাটা কলিজায় তিরস্কারের লবণ লাগাত না।
● ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও সাংবাদিক