বাংলাদেশের জনগণের স্বপ্নের পদ্মা সেতু ২০২২ সালের জুনে চালু করা হবে বলে সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয়েছে। একই দিনে সেতুর সড়কপথ ও রেলপথ খুলে দেওয়া হবে বলে বারবার জনগণকে আশ্বস্ত করা হচ্ছে, যদিও কাজের অগ্রগতি বিবেচনায় সেতুর রেলপথের কাজে আরও বিলম্ব হবে বলে ওয়াকিবহাল মহলের ধারণা। ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর সেতুর মূল কাঠামোর ৪১টি স্প্যানের শেষ স্প্যানটি বসানোর কাজ সম্পন্ন হওয়ায় ওই দিন সারা দেশে উৎসবমুখর আমেজ তৈরি হয়। সেতুর মূল অবকাঠামো নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার পর বাকি অংশের কাজগুলো শেষ করার জন্য দেড় বছর কেন লাগবে, সেটা আমার মতো আমজনতার কাছে একটা বিস্ময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গত আগস্ট মাসেই সেতুর সড়কপথের পিচঢালাই ছাড়া মূল কাজ সম্পন্ন হয়েছে। সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি এসে সেতুর প্যারাপেট স্থাপনের কাজও সম্পন্ন হওয়ার ঘোষণা এসেছে সেতু কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে। ২৬ সেপ্টেম্বর ঘোষণা করা হলো অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহে সেতুর পিচ ঢালাইয়ের কাজ শুরু করা হবে। এখানেই আমার ঘোর আপত্তি। প্যারাপেট স্থাপন এবং পিচ ঢালাইয়ের কাজ একই সঙ্গে চালিয়ে যাওয়া টেকনিক্যালি খুবই সম্ভব ছিল, কিন্তু কী অজ্ঞাত কারণে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত পিচ ঢালাইয়ের জন্য অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, সেটাই আমি বুঝতে পারছি না।
আষাঢ়-শ্রাবণ মাসের ঘোর বর্ষার সময় পিচ ঢালাইয়ে অসুবিধা হলেও শরৎ কালের শেষ নাগাদ বৃষ্টির ঘনত্ব (ফ্রিকোয়েন্সি), পরিমাণ ও স্থায়িত্ব কমে আসে। যেহেতু সেপ্টেম্বর মাসের শেষে সারা দিন মুষলধারে বৃষ্টির আশঙ্কা অনেকখানি কমে যায়, তাই পয়লা অক্টোবর কিংবা নিদেনপক্ষে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ থেকেই অনায়াসে সেতুর পিচ ঢালাইয়ের কাজ শুরু করা যেত। আমি জোর দিয়ে বলছি, অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে পিচঢালাই পূর্ণোদ্যমে শুরু হলে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যেই (পাঁচ মাসে) পরিকল্পিতভাবে শেষ করে আগামী বছরের মার্চ মাসে সেতুর সড়কপথ উদ্বোধন করার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে। এ জন্যই আমার দাবি, আগামী ২৬ মার্চ ২০২২ তারিখে আমাদের স্বাধীনতা দিবসে পদ্মা সেতুর সড়কপথ উদ্বোধন করার সরকারি ঘোষণা প্রদান করা হোক।
পদ্মা সেতু কর্তৃপক্ষ সেতুর উদ্বোধন কেন জুন মাস পর্যন্ত পেছাতে চাইছে, তা আমার বোধগম্য হচ্ছে না। তিন মাস আগে সেতুর সড়কপথ খুলে দিলে অর্থনীতিতে যে বিপুল ইতিবাচক অভিঘাত সৃষ্টি হবে, তা কি তারা ভালো করে হিসাব করে দেখেছে? এমনিতেই গত ছয় বছরে বহুবার ঠিকাদারদের একাধিক ভুলের কারণে সেতুর নির্মাণকাজ কয়েক দফা বিলম্বিত হয়েছে, ফলে সেতুর নির্মাণ ব্যয়ও কয়েক শ কোটি টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে।
পাঠকদের অনেকে হয়তো জানেন না, কয়েক বছর আগে সেতুর অনেকগুলো স্ট্রিংগার মাওয়া প্রান্তের পদ্মার নদীভাঙনের কারণে নদীতে ভেসে যাওয়ায় সেগুলো আবার দেশের বাইরে থেকে পুনর্নির্মাণ করে আনতে হয়েছিল। ফলে সেতুর ব্যয়ে কয়েক শ কোটি টাকা অপচয় যুক্ত হওয়ার পাশাপাশি নির্মাণকাজ এক বছরের বেশি পিছিয়ে গিয়েছিল। আবার নদীশাসনের কাজের পরিমাণ, ধরন ও প্রাক্কলিত ব্যয় হিসাব করতে ভুল হওয়ায় ওই খাতের ব্যয়ও কয়েক হাজার কোটি টাকা বেড়ে গেছে।
সবশেষে আমরা দেখলাম, নদীতীরের কয়েকটি পিলারের ডিজাইনে ভুল হওয়ায় সেতু থেকে তীরের স্থলভাগে ট্রেন চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টির আশঙ্কায় ওই পিলারগুলো ভেঙে আবার রি-ডিজাইন করে নির্মাণ করতে হচ্ছে। ওপরের প্রতিটি ক্ষেত্রেই পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এবং ঠিকাদারের অদক্ষতার মাশুল গুনতে হয়েছে সরকারকে, যার ফলে সেতুর নির্মাণকাজও কয়েক বছর বিলম্বিত হয়ে গেছে। সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, এসবের সম্মিলিত যোগফল হিসেবে সেতুর প্রকৃত নির্মাণ ব্যয় অরিজিনাল প্রাক্কলনের চেয়ে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা বেশি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। পদ্মা সেতু বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব অর্থায়নের মেগা প্রজেক্ট। এই প্রকল্পের ব্যয় নানা ঘটনা-দুর্ঘটনা-কালক্ষেপণের মাধ্যমে বাড়িয়ে তোলা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তেমনিভাবে সেতুর পিচঢালাই দীর্ঘায়িত করে সেতুর সড়কপথ চালু তিন মাস পিছিয়ে দেওয়াও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সুবিবেচনাবোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
উদ্বোধনের দিনেই সেতুর রেলপথও চালু করতে হবে কেন? ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা-যশোর রেলপথ একেবারেই স্বতন্ত্র একটি প্রকল্প। ৪০ হাজার কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে নির্মীয়মাণ এই রেলপথটি মহাসড়কের গুরুত্বের তুলনায় অনেক কম গুরুত্বের দাবিদার, মহাসড়ক চালু হওয়ার পর রেলপথের গুরুত্ব আরও কমে যাবে। ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা-পায়রা এবং ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা-যশোর-খুলনা-মোংলা মহাসড়ক দুটি দেশের অর্থনীতির দ্বিতীয় সর্বোত্তম যোগাযোগ ও শিল্পায়ন করিডর হিসেবে গড়ে উঠতে যাচ্ছে।
পদ্মা সেতু শুধু দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অপেক্ষাকৃত বঞ্চিত ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে রাজধানী ঢাকা এবং চট্টগ্রামের অর্থনৈতিক লাইফলাইনের সঙ্গে সংযুক্ত করবে না, এটা পুরো অর্থনীতিকে আক্ষরিক অর্থে একসূত্রে গাঁথার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ও অনুঘটকের ভূমিকা পালন করবে।
পাঠকদের এ পর্যায়ে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ২০১২ সালের ৩০ জুন বিশ্বব্যাংক যখন সেতু নির্মাণে বরাদ্দ ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের ঋণ বাতিলের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিল, তখন ২০১২ সালের জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে প্রথম আলোয় প্রকাশিত কলামে বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদদের মধ্যে আমিই প্রথম ওই সিদ্ধান্তকে ‘শাপে বর’ আখ্যায়িত করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের সক্ষমতা যে বাংলাদেশের রয়েছে, তা যুক্তিসহকারে ব্যাখ্যা করে প্রধানমন্ত্রীকে এই সাহসী সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য আহ্বান জানিয়েছিলাম। ওই জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ-পণ্ডিতদের সাবধানবাণী এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের নানা কটুবাক্য উপেক্ষা করে প্রধানমন্ত্রী সংসদে ‘নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের’ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে সারা বিশ্বকে বিস্ময়ে বিমোহিত করেছিলেন। তাঁর ওই সিদ্ধান্তটি বাংলাদেশের আত্মনির্ভর অর্থনীতি বিনির্মাণের ইতিহাসে ‘সবচেয়ে সাহসী মাইলস্টোন’ হিসেবে ইতিমধ্যেই চিহ্নিত হয়েছে।
পদ্মা সেতু শুধু দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অপেক্ষাকৃত বঞ্চিত ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে রাজধানী ঢাকা এবং চট্টগ্রামের অর্থনৈতিক লাইফলাইনের সঙ্গে সংযুক্ত করবে না, এটা পুরো অর্থনীতিকে আক্ষরিক অর্থে একসূত্রে গাঁথার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ও অনুঘটকের ভূমিকা পালন করবে। এটা ঢাকা থেকে মাওয়া-জাজিরা-ভাঙ্গা-পায়রা-কুয়াকাটা-যশোর-খুলনা-মোংলা পর্যন্ত সুবিস্তৃত ‘ইকোনমিক করিডর’ হিসেবে দেশের অর্থনীতির দ্বিতীয়-সর্বোত্তম লাইফলাইন হয়ে উঠবে।
দেশের শিল্পায়নে দেশীয় এবং বৈদেশিক পুঁজি আকর্ষণে ঢাকা-কুমিল্লা-মিরসরাই-চট্টগ্রাম-আনোয়ারা-মাতারবাড়ী-কক্সবাজার-টেকনাফের মতো আরেকটি আকর্ষণীয় গন্তব্য হয়ে উঠতে এই ইকোনমিক করিডরের এক দশকও লাগবে না। কারণ, মোংলা ও পায়রা বন্দর দুটোর সামুদ্রিক যোগাযোগ সুবিধা ২০২২ সালেই পেয়ে যাওয়ার পাশাপাশি নির্মীয়মাণ মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর থেকেও দূরত্বের দিক থেকে এই করিডরটি বেশি ‘কস্ট-ইফেক্টিভ’ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। উপরন্তু, আন্তর্দেশীয় অর্থনৈতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে যদি ভবিষ্যতে গতি সঞ্চারিত হয়, তাহলে এই করিডরটি ঢাকা-চট্টগ্রাম করিডরের চেয়েও অনেক বেশি সুবিধাজনক বিবেচিত হবে। এমনকি মানুষের ঢাকামুখী হওয়ার প্রবণতা নিরসনেও ওপরে উল্লিখিত করিডর তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখবে।
এই সেতুর ফলে দেশের জিডিপি ১ দশমিক ২৬ শতাংশ এবং দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ২ শতাংশ বাড়বে বলে প্রাক্কলিত হয়েছে। এই সেতু দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের নানা ডাইমেনশানে চমকপ্রদ গতিশীলতার সঞ্চার করবে, দেশের আঞ্চলিক বৈষম্যের দ্রুত নিরসনেও অভূতপূর্ব অবদান রাখবে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনগণের জীবন ও জীবিকা কয়েক দশক ধরে বারবার সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস, জলাবদ্ধতা, লবণাক্ততা এবং বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়ে যে দুর্দশার কবলে পতিত হয়েছে, এই সেতুর অর্থনৈতিক সুফল পেয়ে অঞ্চলটি তা থেকে মুক্তি পেয়ে পুনরুজ্জীবিত হবে। এ জন্যই আমার আকুল আবেদন, আগামী রমজান এবং ঈদুল ফিতরের আগেই যেন সড়কপথটির সুফল দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনগণ পেতে শুরু করে, সে জন্য ২৬ মার্চ পদ্মা সেতুর সড়কপথ উদ্বোধন ঘোষণা করা হোক, রেলপথের কাজ ধীরেসুস্থে চলতে থাকুক।
ড. মইনুল ইসলাম অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়