রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হত্যা বা তাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস চালিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার ঘটনা ইতিহাসে কম নেই। লাতিন আমেরিকার ডোমিনিকান রিপাবলিকের প্রেসিডেন্ট রাফায়েল ১৯৩০ থেকে ১৯৬১ সালে হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার আগ পর্যন্ত খুনের রাজনীতি করেই টিকে ছিলেন। ডব্লিউ জন গ্রিন এ হিস্ট্রি অব পলিটিক্যাল মার্ডার ইন লাতিন আমেরিকা: কিলিং দ্য মেসেঞ্জারস অব চেঞ্জ বইয়ে লিখেছেন, উদারভাবে রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর রাজনৈতিক হত্যা, নির্যাতন ও সন্ত্রাস চালানো ছিল রাফায়েল শাসনের বৈশিষ্ট্য। কয়েক দশক ধরে তাঁর বশংবদেরা শত শত সমালোচক এবং সম্ভাবনাময় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হত্যা করেছে।
বাংলাদেশে ২১ আগস্টের গ্রেনেডের হামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা সত্যিই তাঁদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিলেন, এটা বিবেচনায় নেওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ট্র্যাজেডির ঘটনায় এই মাটির লোকজনই জড়িত ছিলেন। সুতরাং ধরে নিতে হবে যে ‘ভিশন অব অ্যানিহিলেশন’ আমাদের সমাজে আছে। সে কারণে খুন ও ধর্ষণের মতো অপরাধের বিচার–প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার সঙ্গে একটা সামাজিক-সাংস্কৃতিক যোগসূত্র আছে কি না, সেটা আমাদের গভীরভাবে খতিয়ে দেখতে হবে।
১৫ আগস্টের বর্বরতা ঘটেছিল জনগণের চোখের আড়ালে, রাতের অন্ধকারে। কিন্তু ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা হয়েছে প্রকাশ্যে। কোনো জনসভায় হামলা চালিয়ে একটি দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দলের মূল নেতৃত্বকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার চেষ্টা চালানোর কোনো নজির স্মরণকালের আধুনিক ইতিহাসে বিরল। আগস্টের দুই রক্তপাতের মধ্যে কোনো যোগসূত্র থাকতেই পারে না, তা
নয়। এমনকি ১৯৭৫ সালে তারিখ হিসেবে ১৫ আগস্ট এবং ২০০৪ সালে মাস হিসেবে আগস্টের মিলটাও লক্ষণীয়। ১৫ আগস্টের মতোই ২১ আগস্টের ঘটনাটিও ছিল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্মূল করার চেষ্টা।
আমাদের প্রচলিত অপরাধে বিচারব্যবস্থা যে ন্যুব্জ হয়ে পড়েছে, তার উদাহরণ হলো ৩০ লাখ মামলা জমে যাওয়ার পরেও রাষ্ট্রযন্ত্র নির্বিকার থাকতে পারছে। আমজনতা আদালতব্যবস্থা থেকে সহজে কোনো প্রতিকার পায় না। দুই টাকার নোট দিয়ে যেমন প্রায় কিছুই কেনা যায় না; সেভাবে কম টাকা খরচ করে প্রায় কোনো ধরনের, হয়তো চুরির মামলাও আর চালানো যায় না। তদুপরি এখনো এই ধারা মোটামুটি ক্রিয়াশীল যে, রাষ্ট্রপক্ষ সক্রিয় হলে এই জেরবার বিচারব্যবস্থার ভেতর দিয়েও একটি প্রতিকার ত্বরান্বিত করা সম্ভব। সামারি ট্রায়াল না করে সাধারণ আদালতে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার সমাপ্তি তার একটি বড় দৃষ্টান্ত। এখন প্রশ্ন হলো, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ১১ বছর পূর্তিতে মামলার অগ্রগতি এতটা মন্থর কেন।
২০০৪ সালের ২১ আগস্টের পরে সংবাদপত্রের পাতাগুলো সাক্ষ্য দিচ্ছে যে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এই বর্বর হত্যাযজ্ঞের বিচার আশা করা হয়নি। গ্রেনেডটি যদি ট্রাকে পড়ত, তাহলে এটা শেখ হাসিনাসহ বিপুলসংখ্যক জাতীয় নেতার প্রাণ কেড়ে নিত। এটা হতে পারত পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে ঘটে যাওয়া দ্বিতীয় বর্বরতম হত্যাকাণ্ড। সুতরাং গুরুত্বের বিচারে এই মামলাটির অহেতুক দীর্ঘসূত্রতা জাতি হিসেবে আমাদের কাণ্ডজ্ঞান, দায়িত্ববোধ ও সততাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
গ্রেনেড হামলার পরে বিএনপি দুই বছর ক্ষমতায় ছিল। তারা বিচার শুরু দূরে থাক, সুষ্ঠু তদন্তই শেষ করতে পারেনি। আমরা অনুমান করতে পারি যে কেন আওয়ামী লীগ বিচার চায়নি। তারা ধরে নিয়েছিল যে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় থেকে যে বিচার করবে, তা বিচারের নামে প্রহসনই হবে। তারা কেবল আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি তুলেছিল। ২১ আগস্ট ২০০৬ প্রথম আলোতে ‘বিচারের আশা করেন না হতাহতদের স্বজনেরা’ শিরোনামে এক প্রতিবেদন ছাপা হয়। এতে বলা হয়, আহত ও নিহতদের স্বজনদের একটাই চাওয়া, অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। তবে এ সরকারের কাছে তাঁদের কোনো প্রত্যাশা নেই।
এমনকি ঘটনার দুই দিন পর আতাউস সামাদ ‘এরপর আর বাকি থাকল কী’ শিরোনামে প্রথম আলোর প্রথম পাতায় একটি মন্তব্য প্রতিবেদন লিখেছিলেন। সেখানেও তিনি বিচারের প্রসঙ্গ টানেননি। বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া বিচ্ছিন্নভাবে একটি মন্তব্য করেছিলেন যে সরকার বোমাবাজদের শনাক্ত করে ‘দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি’ দিতে বদ্ধপরিকর। খবর বেরিয়েছিল, প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু বিরোধী দলের নেতার তরফে তাতে সাড়া মেলেনি। আর শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘আল্লাহ যখন আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন, তখন একদিন এর বিচার করা হবে। যারা খুনিদের রক্ষা করে চলেছে, তাদেরও বিচার করা হবে।’ তাহলে দাঁড়ালো আগে বিচারের পরিবেশই ছিল না, এখন পরিবেশ থাকলেও বিচার বিলম্বিত হচ্ছে।
২০০৬ সালে শেখ হাসিনা আরও বলেছিলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী, তাঁর ছেলে তারেক রহমান এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দায়ী। তাই দুই বছরেও কোনো একজন অপরাধীও ধরা পড়ল না।’ বিএনপি জজ মিয়া নাটকের বাইরে বিচারপতি জয়নুল আবেদীনকে দিয়ে একটি প্রশ্নবিদ্ধ তদন্ত কমিশন করে। এই কমিশন কী করে ‘বিদেশি হাত’ পেলেন, তা জনগণের সামনে পরিষ্কার হওয়া উচিত। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির জবাবদিহিও অনেক সময় অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, বিচারপতি জয়নুল তার একটি দৃষ্টান্ত। এই বিচারকের বিরুদ্ধে দুদক দুর্নীতির মামলা চালু করেছিল এবং তা থমকে আছে বলেই মনে হয়। আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, যিনি গ্রেনেড হামলার একজন ভিকটিম এবং তিনি দাবি করেছেন যে তাঁর কমিটি এই মামলার নজরদারি করছে, তাদের উচিত হবে ওই কমিশনের প্রতিবেদনের ওপর একটি শুনানির আয়োজন করা। প্রয়োজনে গোপনে শুনানিতে অংশ নিতে বিচারপতিকে ডাকা যেতে পারে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের পর বিদেশি যোগসূত্র খতিয়ে দেখতে রাষ্ট্র নির্বিকার থাকছে। এখানেও উটপাখি নীতি কাম্য নয়। বিদেশি বন্ধুরাষ্ট্র জড়িত থাকার ইঙ্গিত ওই বিচারপতি কীভাবে দিলেন, তা পরিষ্কার হওয়া উচিত। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলাসূত্রে ২০০৫ সালে ইন্টারপোল ও এফবিআইয়ের নয়জন কর্মকর্তা ঢাকা সফর করেছিলেন। তখন তাঁদের পর্যবেক্ষণ কী ছিল, তা আমরা জানতে চাই।
আইন ও বিচারমন্ত্রী আনিসুল হক চলতি বছরের মধ্যে ‘বিচার শেষ’ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। তাঁর আশ্বাসকে স্বাগত জানাই। কিন্তু আমরা যদি একই সঙ্গে কতগুলো পদক্ষেপ নিতে না দেখি, তাহলে তা আমাদের আশ্বস্ত করবে না। ২০০২ সালের দ্রুত বিচার আইনমতে ট্রাইব্যুনাল ৯০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ করার ম্যান্ডেট প্রাপ্ত। মুলতবি ছাড়াই টানা শুনানির বিধান আছে। ৯০ দিনের বেশি দরকার পড়লে সুপ্রিম কোর্টকে জানিয়ে প্রথমে ৩০ এবং শেষবারের মতো ১৫ দিন অর্থাৎ আরও ৪৫ দিন টানা শুনানি করে বিচার শেষ করতে হবে। মোট ১৩৫ দিনের মধ্যেও না পারলে মামলা যে আদালত থেকে দ্রুত বিচার ট্রাইবু্যনালে স্থানান্তরিত হয়েছিল, সেখানে ফেরত যাবে এবং সেখানে চলবে। আইনের এসব শর্তের কোথাও কোনো ব্যত্যয় ঘটছে কী?
বর্তমান বাস্তবতা হলো, সাক্ষীর সংখ্যা ৪৯১ এবং আসামির সংখ্যা ৫২। ২০০৮ সালে বিচার শুরু হয়। গত সাত বছরে ১৭৪ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। এই গতিতে চললে আওয়ামী লীগ ২০১৯ সালের নির্বাচনে জয়ী হলেও সেই মেয়াদে রায় মিলবেই, তেমনটা হলফ করে বলা যায় না। ফলে সবাইকে সাক্ষ্যের জন্য ডাকার প্রয়োজন পড়বে না বলে হবে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে যে বক্তব্য দেওয়া হয়েছে, তার বাস্তবায়ন জরুরি। দুই বছর ধরে সপ্তাহে দুই দিন গ্রেনেড মামলা আর বাকি তিন দিন অন্য মামলা শুনছেন ট্রাইবু্যনাল, এটা বোধগম্য নয়।
জিল্লুর রহমান ২০০৫ সালের ২১ আগস্ট বলেছিলেন, ‘এই সরকার আইভি হত্যার বিচার করবে না। কিন্তু আমার বিশ্বাস বিচার একদিন হবে।’ এরপর জিল্লুর রহমান দেশের রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। কিন্তু বিচার দেখে যেতে পারেননি।
সম্প্রতি ৭৬ শিশুহত্যা-সংক্রান্ত প্যারাসিটামল মামলার প্রথম আদালতের রায় পেলাম ২৩ বছর পর। এখন আরও অন্তত তিন ধাপ বাকি। সুতরাং আইনমন্ত্রী এ বছরে ‘বিচার শেষের’ যে আশ্বাস দিয়েছেন, তা যথাযথ নয়। ১১ বছরে যদি আমরা প্রথম রায়টি পাই, তাহলে সেটি সুপ্রিম কোর্টে রিভিউ পর্যন্ত আরও তিন ধাপ পেরোতে কত বছর লাগবে, আমরা তা অনুমান করতে অক্ষম। আমরা স্মরণ করি যে, ট্রাইবু্যনালের মামলার ‘একটানা বিচারকার্য’ ও মুলতবি বিষয়ে তদারকির এখতিয়ার সুপ্রিম কোর্টের রয়েছে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
[email protected]