এই যে ২০২১, তোমাকে বলতে চাই কতগুলো গোপন বেদনার কথা। এমনি করে একদিন ২০২০ ও ২০১৯-কেও বলেছিলাম। কিন্তু কেউ কথা রাখেনি।
একদিন ২০২০–কে স্বাগত জানিয়ে ২০১৯–এ ঘটে যাওয়া অনেক কষ্টের কথা বলেছিলাম। বলেছিলাম পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টা ও বনানীর এফ আর টাওয়ারে আগুনের কথা। কত মানুষ যে নিঃস্ব হয়েছিল কে রাখে তার হিসাব।
২০২০–কে বলেছিলাম, ‘তোমার কাছে এমনটি প্রত্যাশা করি না।’ কিন্তু তার প্রতিদান কী পেলাম?
এই তো কিছুদিন আগে ২৭ নভেম্বর গভীর রাতে ঢাকার মহাখালীর সাততলা বস্তিতে আগুন লাগল। ১৬ ঘণ্টার ব্যবধানে বিকেলে আগুন ধরল মোহাম্মদপুরের জহুরি মহল্লায়। এ আগুন নিভতে না নিভতে রাত আড়াইটায় পুড়ে গেল মিরপুর বাউনিয়াবাদ এলাকার বস্তি। প্রায় একই সময় তিনটি বস্তিতে আগুন। শত শত ঘরবাড়ি, দোকানপাট পুড়ে ছাই। সবকিছু হারিয়ে অসহায়–দরিদ্র মানুষকে ঠাঁই নিতে হয় খোলা আকাশের নিচে।
বস্তির আগুনের অনেক গল্প আছে। এটা হতে পারে ক্ষমতার আগুন, দখলের আগুন অথবা ভবন নির্মাণের আগুন। যে আগুন যেমনই হোক, যারা নিঃস্ব হয়ে পথে বসে, প্রিয়জন হারায়, তাদের জীবনের স্বপ্ন ফিরে আসে না আর কোনো দিন। এমনি করে ২০২০ আগুনে বিপন্ন করে দিয়েছে হাজার হাজার মানুষের স্বপ্ন।
নিষ্ঠুরতম শব্দ মৃত্যু। ২০১৯ সালে বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ ও ফেনীর মাদ্রাসাশিক্ষার্থী নুসরাত জাহানের মৃত্যু সারা দেশের বিবেককে নাড়িয়ে দিয়েছিল। ২০২০-এর কাছে প্রার্থনা করেছিলাম আর যেন এমন মৃত্যু না হয়।
কিন্তু কথা রাখেনি ২০২০। কক্সবাজার পুলিশ চেকপোস্টে মেজর সিনহার মৃত্যু, হাসপাতালে সেবা নিতে গিয়ে সহকারী পুলিশ সুপার আনিসুল করিমের মৃত্যু, পুলিশ ফাঁড়িতে রায়হান আহমেদ নামের সিলেটের যুবকের মৃত্যু ও লালমনিরহাটের আবু ইউনুস মোহাম্মদ শহীদুন্নবীকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার ঘটনা আমাদের মধ্যযুগীয় রোমহর্ষক মৃত্যুর কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।
২০১৯–এ এক কেজি পেঁয়াজের দাম উঠেছিল ৩০০ টাকায়! সেবার দেশি পেঁয়াজ কিনতে পারতাম না। অল্প করে আফ্রিকার পেঁয়াজ কিনে মনের দুঃখে রেললাইন ধরে ঘরে ফিরতাম।
২০২০–এর কাছে মিনতি করে বলেছিলাম, তুমি গরিব মানুষদের দেখে রেখো। প্রতিদিন তারা যা খেয়ে বেঁচে থাকে, সেসবের দাম যেন না বাড়ে। কোনো কথাই সে রাখল না। শুনল না। চাল, ডাল, আলু হলো গরিবের প্রায় নিত্যদিনের খাবার। এবার এক কেজি আলুর দাম হয়েছে ৪০ থেকে ৫০ টাকা!
২০২১, তোমাকে মনে করিয়ে দিই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই মেয়েটির কথা। সেটি ২০২০–এর জানুয়ারির ৭ বা ৮ তারিখ হবে। সেদিন ঘরে ফিরতে তার প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যায়। কিন্তু বাস থেকে ভুল জায়গায় নেমে পড়ে। সেই ছোট্ট ভুলই তার জীবনের স্বপ্নগুলো, আনন্দগুলো ভেঙে চুরমার করে দেয়। সে রাতে মেয়েটি সেখানে ধর্ষণের শিকার হয়েছিল। এভাবেই শুরু হলো ২০২০–এর নিষ্ঠুরতা।
ইতিহাসে ২০২০–এর নাম লেখা থাকবে এক ভয়াবহ দুর্যোগের বছর হিসেবে। করোনার মতো এক বিরল প্রজাতির ভয়ংকর মৃত্যুদূত আমাদের ঘাড়ে চেপে বসেছে। ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী ধরা পড়ে। সেই শুরু। দেশের মন্ত্রী, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, চিকিৎসক, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য, পুলিশ, আমলা, সাংবাদিক, ব্যাংকার, ব্যবসায়ীসহ এমন কোনো শ্রেণি–পেশার মানুষ নেই, করোনায় যাঁদের মৃত্যু হয়নি।
২০২১, তোমাকে করজোড়ে অনুরোধ করি, তুমি ২০১৯-২০২০–এর মতো হয়ো না। তুমি পৃথিবীকে মহামারি থেকে মুক্তি দিও। তোমাকে নিয়ে যেন ২০২২–এর কাছে অভিযোগ করতে না হয়।
আশফাকুজ্জামান সাংবাদিক ও সংগঠক