এক বাজে সময় পার করছে দেশ। গত কয়েক দিনে একের পর এক সনাতন ধর্মাবলম্বীদের শারদীয় দুর্গাপূজার মণ্ডপ, মন্দির ও বসতবাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটেছে ও ঘটছে। পবিত্র কোরআন অবমাননার অভিযোগে কুমিল্লায় পূজামণ্ডপে হামলার পর সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। পুরো ঘটনার দায় সরকারকেই নিতে হবে। হালকা কথাবার্তা বলে উদ্ভূত পরিস্থিতি এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। কুমিল্লার ঘটনার রেশ ধরে প্রাণহানিও হয়েছে চাঁদপুরে। বিক্ষুব্ধ জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, পরিস্থিতি গুলিবর্ষণের ঘটনা পর্যন্ত গেল কেন? ভাঙচুর, হামলা, লুটপাটের পূর্বাভাস কি সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আগাম অনুমান করতে পারেনি। বিরোধী দলের চার থেকে পাঁচজন বসে ঘরোয়া বৈঠক করলেই গোয়েন্দারা দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের আভাস পেয়ে ধরে নিয়ে আসেন। আর সময় নিয়ে পরিকল্পিতভাবে মন্দিরে, পূজামণ্ডপে হামলা করলেও গোয়েন্দারা তা ধরতে পারছেন না, এটা অবিশ্বাস্য।
কুমিল্লায় স্থানীয় লোকজন অভিযোগ করেন, পূজামণ্ডপে হামলা ও লুটপাটের পর পুলিশ এসেছে, একই অবস্থা রামুতেও হয়েছিল। সেখানে ট্রাকে লোক এসে বৌদ্ধমন্দিরে হামলা করেছে। নাসিরনগরে কয়েক ঘণ্টা ধরে হামলা করা হয়েছে। শাল্লায় তো মাইকিং করে লোক জড়ো করা হয়েছে। বিভিন্ন ঘটনায় দেখা যাচ্ছে দীর্ঘ প্রস্তুতি নিয়ে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা করা হয়। হামলার সময় সরকারি দলের লোকজন কোথায় থাকে? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারি দলের তাণ্ডবে বিএনপিসহ কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীই তো মাঠে দাঁড়াতে পারেন না। তাহলে সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় উপাসনালয়, বাড়িঘরে হামলাকারীদের সরকার আটকাতে পারছে না কেন? এরা কি সরকারের থেকেও শক্তিশালী? দেশি-বিদেশি চক্র কি এ হামলায় উসকানি দিচ্ছে? নাকি সরকার হামলা আটকাতে চায় না, বরং সুবিধা নিতে চাইছে? জনমনে এখন নানা ধরনের প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।
প্রতিটি হামলার পরই সরকারের তরফ থেকে অপশক্তি, ষড়যন্ত্রকারী, বিরোধী দলের লোকজনকে দায়ী করা হয়। এসব নিয়ে হাস্যকর ধরনের কিছু টক শো হয়। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বিরোধী দলের পিণ্ডি চটকানো হয়। একদল আবার এ সুযোগে ধর্মবিদ্বেষ নিয়ে মাঠে নামে। একসময় নানা সংবাদের ভিড়ে হামলার ঘটনা হারিয়ে যায়। কিছুদিন পর আবার নতুন কোনো ঘটনায় নতুন করে হামলা করা হয়। বিরোধী দল হামলা, মামলা, গুম, খুনে জেরবার। সাধারণ রাজনৈতিক কর্মসূচি পর্যন্ত পালন করতে পারে না। সেখানে মাইকে ঘোষণা দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে দেশজুড়ে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা করার মতো শক্তি বিরোধী দলগুলোর আছে কি না, তা ভাবনার বিষয়।
বরং বিভিন্ন হামলায় সরকারি দলের লোকজনের সম্পৃক্ততার তথ্য উঠে এসেছে। নাসিরনগর ও শাল্লার ঘটনায় এমনটাই শোনা গেছে। বান্দরবানের লামায় কোরআন অবমাননার প্রতিবাদ সভায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। ওই সমাবেশ শেষে পূজামণ্ডপের ফটক ভাঙচুর এবং স্থানীয় হরিমন্দিরে হামলা করা হয়। এ ছাড়া হিন্দুদের ৪০টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও ৮টি বসতঘর ভাঙচুর ও লুট করা হয়।
এক দশক ধরেই দেশে ধারাবাহিকভাবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা হয়েছে। এসব হামলার কোনো সুরাহা হয়নি। হামলার দায়ে কারও সাজাও হয়নি। বরং নাসিরনগরে হামলায় জড়িত ব্যক্তিদের ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল। সমালোচনার মুখে তাঁদের মনোনয়ন প্রত্যাহার করা হয়। পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, সংখ্যালঘুদের ওপর প্রতিটি হামলার-পূর্ববর্তী ও পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ কমবেশি একই ধরনের। প্রথমে ইসলাম ধর্ম অবমাননার বিষয়টি ছড়িয়ে দিয়ে পরিস্থিতি গরম করে তোলা হয়। ছড়িয়ে দেওয়া অভিযোগগুলো কতটা বাস্তব ও যৌক্তিক, এসব বিবেচনা না করেই একদল লোক হইহই করে মন্দির বা হিন্দু অধিবাসীদের ঘরবাড়িতে হামলা শুরু করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হামলাকারীরা স্থানীয় নয়। ভিন্ন এলাকা থেকে এসে হামলা করে। এমনও হয়েছে, ট্রাকে লোক নিয়ে এসে হামলা করা হয়েছে।
সংখ্যালঘুদের ওপর ঘন ঘন হামলার সঙ্গে অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ছাড়াও আঞ্চলিক রাজনীতির প্রভাব থাকতে পারে। আগামী বছরের শুরুতেই ভারতের পাঁচটি প্রদেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ভারতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ঝোঁক প্রবল। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন মানে ভারতে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির ভোটের পালে হাওয়া। এর কিছু লক্ষণ বা নমুনা সম্প্রতি ভারতের রাজনীতিবিদদের আচরণে প্রতিফলিতও হয়েছে। কুমিল্লায় পূজামণ্ডপে হামলার পরপরই পশ্চিম বাংলার বিজেপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক সরাসরি বাংলাদেশে হস্তক্ষেপের কথা বলেন। তঁাদের এ ধরনের মন্তব্য নতুন নয়। ভারতীয় রাজনীতিবিদদের এ ধরনের বালখিল্য মন্তব্য দেশের সংখ্যালঘুদের আরও ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেয়। বাংলাদেশের সমস্যা বাংলাদেশিরাই সমাধান করবে, ভারত নয়।
ধর্ম অবমাননার অভিযোগ শুনেই হুড়মুড় করে উত্তেজিত হয়ে হামলা করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। কেউ ধর্ম অবমাননা করলে দেশের আইন অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। সরকার কোনো ব্যবস্থা না নিলে সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে হবে। কিন্তু কথা নেই, বার্তা নেই অকারণে নিরীহ মানুষের ওপর হামলা কোনোভাবেই সভ্য আচরণ হতে পারে না। হামলা, লুটপাটের একমাত্র অর্জন হচ্ছে প্রাণহানি ও সম্প্রদায়গত পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের সুতাটা ছিঁড়ে দেওয়া। মনে হচ্ছে আড়াল থেকে একটি গোষ্ঠী এ কাজই করছে।
হঠকারী জনতার মতোই পুলিশও অসহিষ্ণু আচরণ করছে। চাঁদপুরে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু এতে কি হামলা আটকানো গেছে? চাঁদপুরে পুলিশি হত্যাকাণ্ডের পরও দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলা হয়েছে। হুটহাট গুলির অভ্যাস পুলিশকে বন্ধ করতে হবে। গুলিবর্ষণ না করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। শুরুতে ঢিলেমি করে পরে উত্তেজিত জনতাকে গুলি করে হত্যা পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করে তোলে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে জনগণকে উত্তেজিত করে দেশকে অস্থিতিশীল করার লক্ষ্য নিয়ে একটি মহল মাঠে নেমেছে।
একটা জিনিস মনে রাখতে হবে, ধর্মীয় অবমাননার প্রতিবাদ নিশ্চয়ই করতে হবে, কিন্তু তা করতে হবে বুঝেশুনে। গুজবে কান দেওয়া যাবে না। হুজুগে গা ভাসিয়ে দেওয়া দেশের জন্য কখনোই মঙ্গলজনক হবে না। প্রতিবাদের নামে যেন প্রতিপক্ষের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া না হয়। ভুল করলেই সামনে সমূহ বিপদ অপেক্ষা করছে।
ড. মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক