২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

হাজি সেলিমও কি হাসপাতালে আয়েশি জীবন কাটাবেন?

হাজি সেলিম

অবশেষে আদালতে আত্মসমর্পণ করেছেন হাজি সেলিম। জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের মামলায় তাঁর ১০ বছরের সাজা খাটতে হবে। এ মামলায় ১৩ বছর আগে বিচারিক আদালতের রায়ের পর তাঁকে মাসখানেক কারাগারে থাকতে হয়েছিল। পরে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে জামিনে বের হন তিনি। মাঝের এ সময় তিনি দুবার সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হন। এখন সেই সাজা বহাল রেখে হাইকোর্টের দেওয়া পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হওয়ার পর আত্মসমর্পণ ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না আসলে। যদিও দণ্ড মাথায় নিয়ে অতি গোপনেই বিদেশে ‘পালিয়ে গিয়ে’ দেশজুড়ে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত ফিরেও এলেন, সেটি যদিও স্বেচ্ছায় নাকি বাধ্য হয়ে, বলাটা মুশকিল। গত রোববার আত্মসমর্পণ করলে আদালত তাঁকে কারাগারে পাঠান। সরকারি দলের সংসদ সদস্য হয়ে সাজা খাটতে জেলে যাওয়ার ঘটনা বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনীতির জন্য কল্পনাতীতই বলা যায়।

এখন কি হাজি সেলিম ১০ বছর জেলে কাটাবেন? সেটির উত্তর পেতে আরও অপেক্ষা করতে হবে। হাইকোর্টের পর আপিল বিভাগ, এরপর আপিলের রিভিউ; সেখানেও যদি ঠেকে যান, মহামান্য রাষ্ট্রপতির প্রতি আবেদন তো আছেই। বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে হাইকোর্টের আদেশের মাধ্যমে সাজা বাতিল করতেও সক্ষম হয়েছিলেন হাজি সেলিম। কিন্তু দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পাল্টা আপিলের ফলে সেই সাজা বহাল করেন হাইকোর্ট। অনেকে অবাকই হতে পারেন, দুদক কবে এমন ‘নাছোড়বান্দা’ হলো! যা-ই হোক, আত্মসমর্পণের পর পরবর্তী আইনি মোকদ্দমার প্রক্রিয়া চলাকালীন হাজি সেলিম আসলে কোথায় থাকবেন, সেই প্রশ্নও ওঠে। তবে এক দিনের ভেতরে সেটির উত্তর পাওয়া গেল।

আদালত এই সংসদ সদস্যকে কারাগারে পাঠালে সেখানে কষ্ট করে এক রাত থাকতে হয়েছে তাঁকে। পরদিন সোমবার সকালেই কারাগার থেকে তাঁকে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আত্মসমর্পণের দিন আদালতে অসুস্থ হয়ে শুয়ে পড়ার দৃশ্য দেখে তেমনটিই আসলে ধারণা করা গিয়েছিল।

হাজি মো. সেলিম গত রোববার আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। ঢাকা, ২২ মে
ছবি: দীপু মালাকার

কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার মো. মাহাবুবুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, হাজি সেলিম হৃদ্‌রোগসহ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন। আদালত হাজি সেলিমকে সুচিকিৎসা দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। সেই নির্দেশনা মেনেই বিএসএমএমইউতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাঁকে। অন্যদিকে বিএসএমএমইউ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নজরুল ইসলাম খান জানান, তিনি হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত। হাসপাতালে হৃদ্‌রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে তাঁকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

এখন কথা হচ্ছে, আদালত হাজি সেলিমের সুচিকিৎসার নির্দেশ দিয়েছেন, কিন্তু সেটির জন্য প্রথমে তাঁকে কেন্দ্রীয় কারা হাসপাতালে কেন নিয়ে যাওয়া হলো না? হৃদ্‌রোগের চিকিৎসার ন্যূনতম সামর্থ্যও কি সেখানে নেই? এর উত্তর হতে পারে সেখানে হয়তো জায়গা খালি ছিল না। সেটি অস্বাভাবিক কিছু নয়। ১৭০ শয্যার ওই হাসপাতাল সুস্থ কারাবন্দীদের দ্বারাই হয়তো পরিপূর্ণ ছিল। অধিকাংশ সময় তা–ই তো থাকে বলে আমরা শুনে থাকি।

ভিআইপি বন্দীদের কারাগারের বাইরে হাসপাতালের কেবিনে দিনের পর দিন থাকার সুযোগ করে দেওয়া এ দেশে একধরনের ‘কালচারই’ পরিণত হয়ে গেছে বলতে গেলে। এর জন্য মোটা অঙ্কের অর্থের লেনদেন হয় বলেও আমরা শুনে থাকি। কারাগার কর্তৃপক্ষ, কারা হাসপাতাল আর যে হাসপাতালে নেওয়া হবে—এ তিন জায়গার সম্মিলিত প্রয়াস বলা যায়। আর ‘ওপরের মহল’ নামের বিশেষ একটি জায়গার গ্রিন সিগন্যাল তো লাগেই।

২০১৯ সালের জানুয়ারিতে হটলাইনে অভিযোগের ভিত্তিতে দুদকের একটি টিম আচমকা এক অভিযান চালিয়েছিল কারা হাসপাতালটিতে। সেখানে গিয়ে তাঁরা দেখতে পান দুই-তৃতীয়াংশ সিটই সুস্থ কয়েদিদের দখলে। হাসপাতালের সিটে আয়েশি জীবনযাপন করছিলেন তাঁরা। কিছু কক্ষে টেলিভিশন, রেফ্রিজারেটর, ওভেন ইত্যাদি নিয়ে ভালোই জমিয়ে ফেলেছেন কয়েদিদের অনেকে। তাঁদের ভিড়ে স্বাভাবিকভাবে সেখানে হাজি সেলিমের জায়গা না হতেই পারে। তা ছাড়া হাসপাতাল হলেও সেটি তো কারাগারের ভেতরেই। একজন সংসদ সদস্য হিসেবে সেখানে থাকাটা কি হাজি সেলিমের জন্য সম্মানজনক হবে? সে জন্যই হয়তো তাঁকে চোখ বন্ধ করে বিএসএমএমইউতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে!

কে না জানে, ভিআইপি কারাবন্দীদের জন্য যথেষ্ট ‘আরাম-আয়েশের’ ব্যবস্থা আছে বিএসএমএমইউতে। ডেসটিনির এমডি রফিকুল আমীন তো সেখানেই মাসের পর মাস কাটিয়ে দিয়েছেন, এমনকি জুম মিটিং করে নতুন করে এমএলএম কার্যক্রমও শুরু করে দিয়েছিলেন। ডেসটিনির চেয়ারম্যান ও সাবেক সেনাপ্রধান হারুন-অর-রশিদও হাসপাতালটির আয়েশি জীবনের স্বাদ নিয়েছেন। আট মাসের বেশি সময় ধরে সেখানে ভিআইপি হালেই ছিলেন ক্যাসিনো-কাণ্ডে গ্রেপ্তার বিতর্কিত ঠিকাদার জি কে শামীম। ক্যাসিনো-কাণ্ডে গ্রেপ্তার আরেক আলোচিত নাম ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট বন্দিত্বের প্রায় পুরো সময়টাই বিএসএমএমইউতে কাটিয়ে দিয়েছেন। সেখানে রাজনৈতিক কর্মীদের সঙ্গে নিয়মিত দেখাও করতেন তিনি।

আরও পড়ুন

আলোচিত ইয়াবা কারিগর আমিন হুদার কথা অনেকের মনে আছে নিশ্চয়ই। ৭৯ বছর সাজা পাওয়া আমিন হুদা প্রায় দুই বছরই কাটিয়েছেন হাসপাতালের কেবিনে। হাসপাতালের ভিআইপি কেবিনের ভাড়াই দিয়েছেন তিনি কোটি টাকার বেশি। ২০২০ সালে তিনি মারা যান।

কারাবন্দী হয়েও এমন ‘মুক্ত জীবন’ কাটানোর তালিকাটা দীর্ঘই হবে। হাসপাতালে তাঁদের আয়েশি জীবনে বাগড়া দিয়ে বসে সংবাদমাধ্যমগুলো। তখন কয়েক দিনের জন্য আবার কারাগার থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসা হয় তাঁদের।

অনেকটা ‘ওপেন সিক্রেটের’ মতোই ব্যাপারটা। ভিআইপি বন্দীদের কারাগারের বাইরে হাসপাতালের কেবিনে দিনের পর দিন থাকার সুযোগ করে দেওয়া এ দেশে একধরনের ‘কালচারই’ পরিণত হয়ে গেছে বলতে গেলে। এর জন্য মোটা অঙ্কের অর্থের লেনদেন হয় বলেও আমরা শুনে থাকি। সেটিকে কারাগার কর্তৃপক্ষ, কারা হাসপাতাল আর যে হাসপাতালে নেওয়া হবে—এ তিন জায়গার ‘সম্মিলিত প্রয়াস’ বলা যায়। আর ‘ওপরের মহল’ নামের বিশেষ একটি জায়গার গ্রিন সিগন্যাল তো লাগেই।

এমনকি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত এক শিল্পপতিপুত্র ইয়াসিন রহমানের হাসপাতালে ‘রাজার হালে’ কারাজীবন কাটানোর খবর আমরা পত্রিকায় পড়েছি। সেখানে বসে দিব্যি ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডও চালিয়ে নেন অনায়াসে। এ মাসেই ডেসটিনির মামলায় রফিকুল আমিনের ১২ বছর ও এমডি ও হারুন-অর-রশিদের চার বছরের কারাদণ্ড হয়েছে। কারাবন্দী থাকা অবস্থায় তাদের সাজা কাটা হয়ে গেছে বলতে গেলে, সেটি আরাম-আয়েশেই। এখন অন্যরা যদি এমন ‘সুযোগ-সুবিধা’ পেয়ে থাকেন, সেখানে হাজি সেলিম কী দোষ করলেন! একজন সংসদ সদস্য হিসেবে তাঁর আরও বেশি ‘অধিকার’ থাকার কথা।

কারাবন্দীদের চিকিৎসা বা হাসপাতালে থাকা নিয়ে আরেকটি প্রসঙ্গ চলেই আসে। সাধারণ কয়েদিদের বাইরের হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার তো প্রশ্নই আসে না, কিন্তু কারা হাসপাতালেই সেই সুযোগ পান কি তাঁরা? সেখানে চিকিৎসা নিতে শুধু অসুস্থ হলেই চলে না, হাসপাতালে ভর্তির অনুমতিপত্র লাগে। সেটি আবার দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ব্যাপার, অভিযোগ আছে টাকা খরচ করলে সেটি আর দীর্ঘ থাকে না। আবার টাকা খরচ করলে হাসপাতালে থাকার জন্য অসুস্থও হওয়া লাগে না, সেটি দুদকের অভিযানেই দেখা গেছে। বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ২০২০ সালের এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, পাঁচ বছরে জেলখানায় মারা গেছেন কমপক্ষে ৩৩৮ জন বন্দী। এসব ঘটনায় কারণ হিসেবে উল্লেখ থাকে স্বাভাবিক মৃত্যু বা আত্মহত্যা। এর বাইরে আর কিছু জানার সুযোগ নেই। তবে মৃতের পরিবার ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর অভিযোগ, সামর্থ্যহীনদের অনেকেই বিনা চিকিৎসায় বা যথাযথ চিকিৎসা না পেয়ে বা চিকিৎসা পেতে বিলম্বের কারণে মারা যান।

আরও পড়ুন

আবার হাজি সেলিমের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। ১০ বছরের সাজার রায় বাতিল চেয়ে হাজি সেলিমের পক্ষ থেকে লিভ টু আপিল করা হয়েছে। পাশাপাশি জামিনও চাওয়া হয়েছে। এর জন্য আগামী সপ্তাহে চেম্বার আদালতে শুনানি হতে পারে। এখন আইনি প্রক্রিয়া চলাকালীন তাঁকে কত দিন কারাবন্দী থাকতে হতে পারে, সেটি নিশ্চিত করে বলার সময় আসেনি। শেষ পর্যন্ত ১০ বছর সাজা বহাল থাকছে কি না, পাশাপাশি তাঁর সংসদ সদস্য পদও থাকছে কি না, সেসব জানতে হাজি সেলিমকে আরও অপেক্ষা করতে হবে, সেই সঙ্গে আমাদেরও। তবে তত দিন পর্যন্ত তিনি হাসপাতালে আয়েশি জীবন কাটালে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

  • রাফসান গালিব প্রথম আলোর সহসম্পাদক