২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

হাইকোর্টের রায় যেভাবে ভ্রাম্যমাণ আদালতের পক্ষে!

বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি আশীষ রঞ্জন দাসের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ গত ১১ মে, ২০১৭ কামরুজ্জামান খান বনাম বাংলাদেশ মামলায় ২০০৯ সালের ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনকে সংবিধান পরিপন্থী ও এখতিয়ারবহির্ভূত হিসেবে ঘোষণা করেন। এর ৬৪ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ের নির্যাস হলো: সরকারনিয়ন্ত্রিত নির্বাহী অফিসার দিয়ে মানুষকে সাজা দেওয়ার বিধান করে সংসদ সংবিধানের বিরুদ্ধাচরণ করেছে। তারা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও ক্ষমতা পৃথক্‌করণের মতো দুটি মৌলিক কাঠামোকে আঘাত দিয়েছে। আদালত অবশ্যই ভ্রাম্যমাণ আদালতকে স্বাগত জানিয়েছেন। শুধু বলেছেন এটা আমলারা চালাবেন না, বিচারকেরা বিচার করবেন। এক অর্থে এতে নতুনত্ব নেই। সর্বজনীন কথা। যুগে যুগে যা সব সভ্য দেশ মেনে এসেছে।

ভ্রাম্যমাণ আদালতসংক্রান্ত রায়ের পূর্ণ বিবরণ পাঠে আমাদের মনে হয়েছে, এর বিরুদ্ধে আমরা ২০০৭ সালেই যে অবস্থান নিয়েছিলাম, সেটাই যুক্তিগ্রাহ্য হয়েছে। আপাতত অবশ্য হাইকোর্টের রায়ের কার্যকরতা স্থগিত রয়েছে। এখন এ বিষয়ে লিখতে গিয়ে অবসরপ্রাপ্ত নির্বাচন কমিশনার মো. আবদুল মোবারকের সঙ্গে কথা বলি। তিনি এ বিষয়ে একটা গবেষণা করেছেন। তিনি ঢাকার সাবেক জেলা প্রশাসক এবং আইন কমিশনেও ছিলেন। তিনি মনে করেন, নির্বাহী কর্মকর্তাদের দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত চলতে পারে।

তবে তাঁর একটি অপ্রকাশিত নিবন্ধের শুরুটা এ রকম: ‘প্রায় পৌনে দু’ শ’ বছর ভারত শাসনকালে বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং বৃটিশ সরকার এই উপমহাদেশে অনেক আইন প্রবর্তন করে। কোন কোন বিষয়ে বার বার আইন পরিবর্তনও করে। কিন্তু মোবাইল কোর্ট আইন নামে কোন আইন জারি করে নাই।’ তিনি আরও জানাচ্ছেন, ‘৭ অক্টোবর ১৯৫৮ তারিখে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা পাকিস্তানে সামরিক আইন জারি করে জেনারেল মোহাম্মদ আইউব খানকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেন। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মার্শাল ল রেগুলেশন নং ১অ জারি করে প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটদের সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালত পরিচালনা করার ক্ষমতা প্রদান করেন (ঢাকা গেজেট, অতিরিক্ত সংখ্যা, ৯ অক্টোবর ১৯৫৮)। তখন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক অনেক মার্শাল ল’ অর্ডার জারি করেন। তার মধ্যে মার্শাল ল’ অর্ডার নং ৩ দ্বারা দেশের ফৌজদারি আদালতসমূহকে সমন পদ্ধতি অনুসরণ করতে নির্দেশ দেয়া হয়। সমন পদ্ধতি অর্থ সংক্ষিপ্ত বিচার পদ্ধতি।’ তার মানে দাঁড়াচ্ছে, সামরিক শাসনের প্রতি যাতে মানুষের ভয়
থাকে, সেটা নিশ্চিত করাই ছিল এই ব্যবস্থা চালুর লক্ষ্য। ভয়ের শাসন ছিল এর দর্শন। মো. আবদুল মোবারক তাঁর নিবন্ধে দেখিয়েছেন, গুয়াতেমালা, ফিলিপাইন, কঙ্গো, ভারত, পাকিস্তান ও সিয়েরা লিওনে মোবাইল কোর্ট চলছে। আমরা হাইকোর্টের রায়ে তার সমর্থন পাই। তাহলে তর্ক এতটুকুই, এটা আমলারা চালাবেন, না বিচারকেরা? যে কাজ আমলারা পারেন, সেটা বিচারকেরা পারবেন না, সেটা যুক্তিযুক্ত নয়।

মো. আবদুল মোবারক লিখেছেন, ‘দেশভিত্তিক হিসাব করলে দেখা যায় যে সর্বাধিকসংখ্যক মোবাইল কোর্ট চলছে বাংলাদেশে। অন্যান্য দেশের মোবাইল কোর্ট শুধু অপরাধের বিচার করে না বা সংক্ষিপ্ত পদ্ধতিতে বিচার করে না; তাদের মোবাইল কোর্টের উদ্দেশ্য কোর্টকে বিচারপ্রার্থীর বাড়ির কাছে নিয়ে যাওয়া এবং পক্ষদের মধ্যে বিরোধ মীমাংসা করা। সেখানে সারা বছরের জন্য মোবাইল কোর্টের ক্যালেন্ডার তৈরি করে কোন তারিখ কোন সময় কোন স্থানে মোবাইল কোর্ট বসবে, তা আগেভাগে ব্যাপকভাবে প্রচার করে নির্ধারিত সময়ে নির্ধারিত স্থানে পৌঁছে বিচারক প্রচলিত আইন অনুসারে ফৌজদারি ও দেওয়ানি উভয় প্রকার মামলা গ্রহণ করেন। জেলা সদরে আদালত ভবনে বসে যে পদ্ধতিতে বিচার করা হয়, ওদের মোবাইল কোর্টও সেই পদ্ধতিতেই বিচার করে। এতে লাভ এই যে, দরিদ্র বিচারপ্রার্থীর এবং বিবাদীর শহরে যাতায়াতের ও থাকা-খাওয়ার খরচ বাঁচে, সময় বাঁচে, শ্রম বাঁচে—টাউট, বাটপার বা দালালের পাল্লায় পড়ার আশঙ্কা থাকে না এবং সর্বোপরি স্থানীয় লোকজনের উপস্থিতিতে সাধারণত কেউ মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে চায় না। প্রায়ই সত্য সাক্ষ্যই দেয়। ফলে ন্যায়বিচারের পথ সুগম হয়।’ তাহলে প্রশ্নটা সোজা, অন্যান্য দেশে যেভাবে চলে, সেভাবে আমরা চললে অসুবিধা কী?

বিচারকের সংখ্যা বাড়াতে কত কষ্ট। বাজেট থাকে না। কেউ কি শুনেছেন প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যসংখ্যা বাজেটের কারণে থেমে আছে। ১২ মার্চ ২০০৭ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ অ্যাটর্নি জেনারেলকে জানিয়েছিল, পৃথক্‌করণের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য ৮৩৮টি ম্যাজিস্ট্রেট পদ সৃষ্টি করা দরকার। ওই সময় ৭৪৩ মামলাপ্রতি একজন ম্যাজিস্ট্রেট দিতে বলেছিল সরকার। এরপর এক দশক কেটে গেছে, বাস্তবে ৬৩৪ জন ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল বিচার বিভাগ, মামলার চাপ দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে, কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট সংখ্যা রয়ে গেছে অপরিবর্তিত। বাস্তব অবস্থাটা তাই এমনই যে বিচারকেরাই বিচার করবেন, কর্মকর্তারা করবেন না, এই সোজা কথাটার মানে যাঁরা বুঝবেন, তাঁরাও ভয়াবহ বিচারকস্বল্পতার কথা ভেবে নীরবতা পালনকে শ্রেয় মনে করবেন। 

রায় প্রসঙ্গে ফিরি। আদালতের সামনে সরকারের পক্ষ থেকে যখন যুক্তি দেওয়া হয় নির্বাহী হাকিমেরা শুধুই দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ভূমিকা পালন করবেন, তখন তাকে হাইকোর্ট ‘গ্রহণযোগ্য’ বলেছেন। কিন্তু যখন তাঁরা কোনো সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে ঘটনাস্থলেই তাৎক্ষণিক শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা ভোগ করবেন, তখন তা বিচার বিভাগ পৃথক্‌করণের ধারণায় আঘাত হানবে, সে কথা উল্লেখ করেছেন। ভারতের উদাহরণ দিয়ে বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী লিখেছেন, ‘ভারতের ভ্রাম্যমাণ আদালত দরিদ্র এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনে ন্যায্য বিচার নিশ্চিত করে থাকে। ভারতীয় ভ্রাম্যমাণ আদালত প্রকল্পের আওতায় গ্রামে গ্রামে ভ্রাম্যমাণ আদালত বাস সার্ভিস চালু করা হয়েছে। ভারতীয় বিচারপতি এবং মুখ্যমন্ত্রীগণ বলেছেন, ‘মানুষ সাধারণত আদালতে যায়। কিন্তু আজ ভারতে জনগণের কাছে এসেছে আদালত।’ পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনা অনুযায়ী ভ্রাম্যমাণ আদালতের বাস বিভিন্ন জনপদে বিচারকার্য সম্পাদন করে চলেছে। কিন্তু এই আদালতের বিচারকার্য নির্বাহী হাকিম নন, বিচারকেরাই পালন করছেন।’

‘২০০৯ সালে ভারতের পার্লামেন্ট দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে গ্রাম ন্যায়ালয় কার্যকর করেছেন। এই আদালত গ্রামগঞ্জের যেকোনো স্থানে পূর্বনির্ধারিত সময় অনুযায়ী আদালত বসিয়ে থাকেন। এর প্রধানের নাম ‘ন্যায় অধিকারী’। তিনি একজন প্রথম শ্রেণির বিচারিক হাকিম। আর তাই এটা যথাযথই রাষ্ট্রের তিন স্তম্ভের মধ্যকার ক্ষমতার পৃথক্‌করণ নীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। পাকিস্তানেও আইন দ্বারা বিভিন্ন ধরনের ভ্রাম্যমাণ আদালত প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কিন্তু তারা কেউ তাৎক্ষণিকভাবে ফৌজদারি বিচারকার্য সম্পাদন করে না। ইএনডিপির অর্থায়নে সিয়েরা লিওন, কঙ্গো ও সোমালিয়ায় পরীক্ষামূলক ভিত্তিতে ভ্রাম্যমাণ আদালত চলছে। বিচারকদের দ্বারা পরিচালিত সেই সব ভ্রাম্যমাণ আদালত বিচারপ্রার্থী জনগণকে ন্যায়বিচার দিচ্ছে।’

আমরা কর্মকর্তাদের দিয়ে আদালত চালানোকে সব সময় একটি অগ্রহণযোগ্য ‘সমান্তরাল বিচারব্যবস্থা’, ‘এক দেশে দুই বিচার’ বলে আসছিলাম। সর্বোপরি ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনের তফসিলে নিত্যনতুন আইন ঢোকানোকে আমরা বলে আসছিলাম, তোপখানায় সংসদের একটি অবৈধ শাখা (সংসদকে না জানিয়ে তারা যখনই খুশি মূল আইন সংশোধন করে, এতে শতাধিক আইনে বিচারের অধিকার তারা সৃষ্টি করে নিয়েছে), আদালত এ প্রসঙ্গে বিস্ময় প্রকাশ করেন। আদালত বলেন, ‘সংসদের পাস করা কোনো আইনের তফসিল সংশ্লিষ্ট আইনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। অথচ এটা বোধগম্য নয় এবং যুক্তিসংগত নয় যে কেন এবং কীভাবে শুধু সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি করে সময় সময়ে এই তফসিলের সংশোধনী সরকার নিজেই করে চলছে। কোনো সংবিধি সংশোধনের ক্ষমতা সংসদের ‘প্লেনারি পাওয়ার’ বা পূর্ণাঙ্গ ক্ষমতা। আদালতের কথায়, এটা সত্যিই স্তম্ভিত হওয়ার বিষয় যে সংসদ তার আইন সংশোধনের পূর্ণাঙ্গ ক্ষমতা নির্বাহী বিভাগের কাছে ন্যস্ত করেছে।’

আমরা অনেক সময় এটা শুনতে অভ্যস্ত, আচ্ছা ট্রাফিক সার্জেন্টসহ অনেকেই তো জরিমানা করে, তাহলে আমলারা করলে দোষ কী। এর মোক্ষম উত্তর দিয়েছেন আদালত। রাষ্ট্রপক্ষ ২০০৬ সালের গ্রাম আদালত আইনের বরাত দিয়ে যুক্তি দিয়েছিল যে ওই আইনে কিছু অপরাধ সংঘটনের দায়ে অনধিক ৭৫ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে গ্রাম আদালতকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। আদালত এ যুক্তি নাকচ করে দিয়ে বলেন, ‘ক্ষতিপূরণ আর শাস্তিমূলক জরিমানা এক নয়। সুতরাং গ্রাম আদালতের সঙ্গে ভ্রাম্যমাণ আদালতের তুলনা চলবে না। আবার একজন পুলিশ সার্জেন্ট যদি ১৯৮৩ সালের মোটর ভেহিক্যাল আইনে জরিমানা করতে পারেন, তাহলে একজন নির্বাহী কর্মকর্তা কেন একই কাজ করতে পারবেন না? রাষ্ট্রপক্ষের এ প্রশ্নের উত্তরে হাইকোর্ট বলেছেন, ‘পুলিশ সার্জেন্ট শুধুই কোনো বিধান লঙ্ঘনকারীকে নির্ধারিত অঙ্কের টাকা জরিমানা করতে পারেন। তিনি ঘটনাস্থলে আদালত বসিয়ে কাউকে দোষী সাব্যস্ত বা দণ্ড ঘোষণা করেন না।’

উল্লেখ্য, এ মামলায় রাজউকের পক্ষে সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ এফ হাসান আরিফ একটি নতুন যুক্তির অবতারণা করেছিলেন, যা বিবেচনার দাবি রাখে। তাঁর যুক্তি: ‘আইনে বিচারিক হাকিম ও নির্বাহী হাকিমের অস্তিত্ব রয়েছে। তাই নির্বাহী হাকিমেরা যখন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন, তখন তাঁরা সংবিধানের ১১৬(ক) অনুচ্ছেদের আওতায় স্বাধীনভাবে বিচারকার্য পরিচালনা করেন।’ আদালত বলেছেন, এই যুক্তি আপাতদৃষ্টিতে সত্য বলে মনে হয়। কিন্তু আসলে তা নয়। ১১৬ক বলেছে, ‘এই সংবিধানের বিধানাবলী সাপেক্ষে বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিগণ এবং ম্যাজিস্ট্রেটগণ বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন।’

আমরা মনে করি, বাস্তব কারণে এটা খতিয়ে দেখার দাবি রাখে। প্রথম কারণ ভ্রাম্যমাণ আদালতের কাজে শূন্যতা সৃষ্টি করা চলে না। বিচারক নিয়োগ একটি সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। তাই একটা অস্থায়ী ব্যবস্থার কথা বলি। বিচার বিভাগে পর্যাপ্ত লোকবল না দেওয়া পর্যন্ত নির্বাহী হাকিমেরা যখন বিচারকার্য করবেন, তখন তাঁরা সুপ্রিম কোর্টের কাছে জবাবদিহি করবেন। আইন ও বিচারমন্ত্রী আনিসুল হক এর আগে প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নির্বাহী হাকিমদের ওপর সুপ্রিম কোর্টের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার যুক্তির সপক্ষে মত দিয়েছিলেন। তবে এটা শুধুই একটা সাময়িক ব্যবস্থা হতে পারে।

মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷