হলের 'টর্চার সেল' বন্ধ করতেই হবে
বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ‘টর্চার সেল’ আছে। ছাত্র হলগুলোর বিভিন্ন তলায় এই টর্চার সেল কমবেশি থাকে। ‘গণরুম’ বা রাজনৈতিক রুমগুলোও একধরনের ‘টর্চার সেল’। এর বাইরে টিভিরুম, গেস্টরুম বা কমনরুমে চালানো হয় নির্যাতন।
আমরা যখন শিক্ষার্থী ছিলাম, তখনো এসব টর্চার সেল ছিল। সে সময় নির্যাতনের শিকার হওয়া বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই ছিলেন বিরোধী ও বাম সংগঠনের নেতা-কর্মী। সময়ের পরিবর্তনে এখন সেটা ‘সর্বজনীন’ রূপ পেয়েছে। ফেসবুকে ভিন্নমতের কোনো পোস্ট বা গণরুমে ওঠা শিক্ষার্থীদের দলীয় মিটিং-মিছিলে নিয়মিত অংশগ্রহণ না থাকা, এমন যেকোনো কারণেই নেমে আসতে পারে নির্যাতন-নিপীড়ন। এই নিপীড়নের ভয়ে অনেক শিক্ষার্থীকেই ক্লাস, পরীক্ষা বাদ দিতে হয়।
মাত্র কদিন আগেই একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের টক শোতে কয়েকজন শিক্ষার্থী জানতে চেয়েছেন, তাঁদের কেন বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে হলে একটি থাকার জায়গার জন্য বেগার শ্রম দিতে হয়? সেটি দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে চলতে থাকে নিপীড়ন। এসব বন্ধ করার জন্য শিক্ষক হিসেবে আমরা কী করছি? আমি কোনো উত্তর দিতে পারিনি।
না পারার কারণ অনেক। কারণ, ক্ষমতার ঝাঁজে আমরা ক্রমেই জ্বলে যাচ্ছি। বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থা এখন ভয়ের সংস্কৃতির ওপর দাঁড়িয়ে। এর মধ্যে মুক্তিকামিতার কোনো উপাদান নেই। ভয়ের বিস্তার আজ সর্বব্যাপী। আর এটিকে চ্যালেঞ্জ করে ভিন্নমত। ভয়ের বিরুদ্ধে সবচেয়ে মোক্ষম অস্ত্র ভিন্নমত। কেননা, কার্যকর ভিন্নমতের উপস্থিতি ভয়ের সংস্কৃতিকে ধসিয়ে দেয় তাসের ঘরের মতো। এ জন্য ক্রমেই ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা’, ‘ভাবমূর্তি নষ্টের’ অভিযোগ বাড়ছে। ভিন্নমতকে ভয়ংকরভাবে দমন-পীড়ন করাই হয়ে উঠেছে কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের অন্যতম আদর্শ।
শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে হত্যার ঘটনায় শিক্ষার্থী নির্যাতনের বিষয়টি আলোচনায় এলেও এটিই এখানে প্রথম নির্যাতনের ঘটনা নয়। এর আগেও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শাসক দলের ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীদের দ্বারা বহু নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে। গত বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ হলে একটি ক্যালকুলেটরকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের নেতারা মারধর করে রক্তাক্ত করেছিলেন এহসানকে। ছাত্র হলে হরহামেশাই ঘটে যাওয়া ‘ছোটখাটো’ মার খাওয়ার ঘটনার মধ্যে এটি সীমাবদ্ধ থাকেনি, এহসানকে রড দিয়ে বেদম পেটান ছাত্রলীগের ওমর ফারুক এবং তাঁর বন্ধুরা। এ সময় এহসান চোখে মারাত্মক আঘাত পান এবং অজ্ঞান হয়ে যান। তাঁকে একজন নিয়ে যান ঢাকা মেডিকেলে। আবার নিয়ে আসা হয় নির্যাতকদের রুমে। সেখান থেকে এহসান কোনোভাবে বের হয়ে আসেন। এহসানের ওপর নির্যাতনের ঘটনাকে ‘বৈধতা’ দিতে বলা হয় সে ‘শিবির’ করতেন, যদিও কোনোভাবেই তার প্রমাণ মেলেনি। আবরারের ঘটনায়ও তাঁকে ‘শিবির-সমর্থক’ বানানোর চেষ্টা হয়েছে। কেউ শিবির করলেই তাঁকে পিটিয়ে প্রায় অন্ধ বানানো কিংবা মেরে ফেলার দায়িত্ব কে কাকে দিল? কবে থেকে ছাত্রলীগ এই দায়িত্ব নিল?
এর আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্রকে হলের ছাদ থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছিল ছাত্রনেতাদের ‘অবাধ্য’ হওয়ায়। কয়েক দিন আগে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের মিছিল থেকে স্লোগান এসেছিল—‘একটা একটা বাম ধর, ধইরা ধইরা জবাই কর’।
সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই বহু শিক্ষার্থী বিভিন্ন সময়ে ছাত্রলীগের মারধরের শিকার হয়েছেন। তুচ্ছ ঘটনায় যখন-তখন শিক্ষার্থীদের মারধর করেন ছাত্রলীগের নেতারা। চুল বড় রাখা, ছাত্রনেতাদের সালাম না দেওয়া—এমন সব ঠুনকো অজুহাতে মারধর করে হাত-পা ভেঙে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। কথায় কথায় গায়ে হাত তোলার অভিযোগ রয়েছে ছাত্রলীগের হল ও বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির বহু নেতার বিরুদ্ধে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে নতুনদের ‘আদবকায়দা’ শেখানোর দায়িত্ব নেওয়া সিনিয়র ছাত্রদের হাতে র্যাগিংয়ের শিকার হয়ে মার এবং নানা রকম শাস্তি পাওয়া এখন যেন স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শাসক দলের ছাত্রসংগঠন যে কায়দায় ভয় জিইয়ে রেখে তাদের দখলদারি জারি রাখে, সেই একই কায়দায় নতুনদের দেওয়া হয় ‘আদবকায়দা’র শিক্ষা। সেই সঙ্গে বাম সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীদের জন্য দুই-চারটা চড়থাপ্পড়ও বরাদ্দ আছে। এই ভয়ভীতি ও মারধরের আশঙ্কা নিয়েই শিক্ষার্থীরা বাস করছেন গায়ের জোরে দখলে রাখা হলগুলোতে। তাই চিন্তাচেতনায় অসাধারণ শিক্ষার্থীরা অনেক সময় নিজেদের দাবিদাওয়ার মিছিলে আসতেও ভীত থাকছেন। কিন্তু মাঝেমধ্যেই এমন সময় আসে, যখন কোনো ন্যায়ভিত্তিক ও যুক্তিসংগত আন্দোলন ভয়ের সেই শৃঙ্খলটি ভেঙে দেয়। তখন হলে বসবাসকারী শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ক্ষমতাসীনদের নিশ্চিতভাবেই ঘাবড়ে দেয়।
শুধু ছেলেদের হলেই নয়, মেয়েদের হলগুলোতেও চলে নিপীড়ন। সেখানেও রয়েছে রাজনৈতিক রুম। তবে সেটি মূলত ছাত্রীদের ওপর মানসিক নিপীড়ন এবং দলীয় কর্মসূচিতে যেতে অস্বীকৃতি জানালে ‘শিবির’ তকমা দিয়ে হল থেকে বের করার প্রক্রিয়ার মধ্যে জারি আছে। কেউ যেন ছাত্রলীগ কিংবা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের প্রতিবাদী মতামত না প্রকাশ করে, সে জন্য ৫৭ ধারার ভয়ও দেখানো হয়।
হল কর্তৃপক্ষের আসলে ভূমিকা কী? প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখা যায়, হল কর্তৃপক্ষ দাবি করে, এসব বিষয়ে তারা কিছুই জানে না। কেন জানে না? সেখানে চার-পাঁচ ঘণ্টা ধরে একটা ছাত্রকে নির্যাতন করা হলো, মেরে ফেলা হলো, তারা কেউ জানে না কেন? ছাত্রীদের একটি আবাসিক হলের আবাসিক শিক্ষক হিসেবে আমি কিছুতেই মানতে পারি না যে একটি হলে এমন ঘটনা ঘটল, অথচ আপনাদের কেউ খবর দেননি কিংবা খবর পাওয়ার কোনো সুযোগ আপনাদের ছিল না? সহকর্মী হিসেবে মেনে নিলাম, আপনারা জানতে পারেননি। কিন্তু জানার পরও সিসিটিভি ফুটেজ প্রকাশ করতে দেওয়া নিয়ে সংশয় ছিল কেন? আপনাদের এই ইচ্ছাকৃত অমনোযোগিতা, দায়হীনতাই দিনের পর দিন জিইয়ে রাখছে এই টর্চার সেলগুলো। আপনারা এইগুলোর অনুমোদন দেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকেই এই টর্চার সেলের দায় নিতে হবে আর নিতে হবে এই মৃত্যুগুলোর দায়ও। তবে কী আমরা এই খুনি শিক্ষার্থীদের চাষবাদই করছি?
জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]
আরও পড়ুন:
শেরেবাংলা হলজুড়ে মারধরের ভয়