অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের রাতে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় লিখেছিলাম, ‘আপনারা চুপ করে থাকবেন না, কিছু বলুন।’ প্রথম আলোতে ছাপা হয়েছিল। আসলে তখন জানতাম না যে এসব হত্যাকাণ্ডের দিনপঞ্জিকাই লিখে যেতে হবে বছর ধরে। কারণ, অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের পরে যে শোক, যে প্রতিজ্ঞা উচ্চারিত হয়েছিল, আশা করেছিলাম, সেই ক্রোধ আর প্রতিজ্ঞা জন্ম দেবে এক বিশাল প্রতিরোধের। সেই প্রতিরোধ এত বড় হবে যে ফের এমন ঘটনা ঘটানোর সাহস পাবে না খুনিরা। রাষ্ট্র বাধ্য হবে মুক্তমনা লেখকদের বাঁচাতে। অভিজিতের স্ত্রী, বন্ধু রাফিদা আহমেদ বন্যাকে বলেছিলাম সে কথা। আস্থা নিয়েই বলেছিলাম। কিন্তু তেমন ঘটেনি। বরং তারপর ক্রমাগত খুন হয়েছেন ওয়াশিকুর রহমান বাবু, অনন্ত বিজয় দাশ, নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয়, ফয়সল আরেফিন দীপন।
কাটা আঙুল নিয়ে, মাথায় চাপাতির কোপের সাক্ষ্য নিয়ে বেঁচে থাকা বন্যা যখন বড় বিশ্বাসভরে ভাবেন অনেক নতুন মশাল তৈরি হচ্ছে, আমিও সায় দিই। যখন প্রাণপণে বন্যা ভলতেয়ার লেকচার থেকে বিবিসি, রয়টার্স কিংবা মানবাধিকার সংগঠনে বা কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে অসির বিরুদ্ধে মসির লড়াইয়ের শ্রেষ্ঠত্বের কথা বলেন, আমিও উদ্দীপ্ত হই। তারপর, বন্যাও বুঝতে পারেন একদিন, বিচার চেয়ে লাভ নেই। তিনি লেখেন, ‘আমিও বিচার চাই না।’
‘আমিও’ কথাটা আসে; কারণ, পুত্রহত্যার বিচার চান না বলে জানান দেশবাসীকে অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক। তিনি বরং সবার শুভবোধের উদয় হওয়ার জন্য ডাক দেন। যে কারণে অধ্যাপক কাসেম পুত্রহত্যার বিচার চাওয়া থেকে বিরত থাকেন, সেই একই কারণে বন্যাও আর বিচার চান না। আর আমি দেখতে পাই, ৯ আগস্ট ২০১৫-এর প্রথম আলো সাক্ষ্য দিচ্ছে, নিলয়ের হত্যাকাণ্ডের পরে আমার লেখা, ‘আসুন, আমরা বরং চুপ করেই থাকি’।
দুই.
প্রথম খুন হলেন লেখক অভিজিৎ। তারপর খুন হলেন এসব খুনের বিরুদ্ধে যাঁরা সোচ্চার হয়েছিলেন—ওয়াশিকুর, অনন্ত, নিলয়। তারপর খুন হলেন প্রকাশক দীপন, যিনি লেখকের বই প্রকাশ করেছেন। আক্রান্ত হলেন লেখকের স্ত্রী, তারপর আরেকজন প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুল, যিনি অভিজিতের বই প্রকাশ করেছেন। গত মেলায় ‘রোদেলা’ প্রকাশনী বন্ধ করা হয়েছিল। এবার বন্ধ করা হয়েছে ‘ব-দ্বীপ’। সেই সঙ্গে লেখক এবং প্রকাশককে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে।
অভিজিতের আগেও চাপাতির আঘাতে রক্তাক্ত হয়েছেন লেখক হুমায়ুন আজাদ। মুরতাদ ঘোষণা করা হয়েছিল লেখক অধ্যাপক আহমদ শরীফকে। নির্বাসিত হয়েছেন লেখক তসলিমা নাসরিন। নিষিদ্ধ হয়েছে হুমায়ুন আজাদের নারী। এই নিষেধ, গ্রেপ্তার, হত্যার যেন কোনো শেষ নেই। এক অতল গহ্বরে ঢুকেছি, বের হওয়ার রাস্তা জানা নেই।
আরও মুশকিলের বিষয় হলো, যাঁরা একদিন তীব্র প্রতিবাদ করেছেন নারী নিষিদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে, আজ তাঁরা চুপ করে গেছেন যখন ব্লগার হত্যা হচ্ছে। লেখক-প্রকাশকদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এমনকি তাঁরা লেখকদের ‘সতর্ক’ হয়ে লিখতে বলছেন বা কোনো বই পড়া যাবে কি যাবে না, সেই মর্মেও কথা বলছেন। এর মানে দাঁড়ায়, এই ক্রান্তিকালে লেখক-বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও বিভক্তি। আবার তাঁরাই আক্রান্ত। লেখকদের শত ধারা থাকতে পারে, সমালোচনা থাকতে পারে, কিন্তু কোনো লেখকের অন্য লেখককে সতর্ক হয়ে লিখতে বলা বা কারও বই পড়তে নিষেধ করার মতো ঘটনা যখন ঘটতে থাকে, তখন রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীনদের আর প্রথাবিরোধী কোনো মতামতকে তোয়াক্কা করতে হয় না। সেই রাষ্ট্রের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের ওখানেই অবলুপ্তি ঘটে।
তিন.
আমি ভাবি, শওকত ওসমান যদি ক্রীতদাসের হাসি না লিখতেন, যদি মুনীর চৌধুরী কবর না লিখতেন, শিখাগোষ্ঠীর পত্রিকা যদি বের না হতো, কেমন হতো? কেমন হতো যদি জহির রায়হান না বানাতেন জীবন থেকে নেয়া? নিশ্চয়ই ভালো হতো পাকিস্তানিদের জন্য। মুক্তিযুদ্ধ করে আসা একটা জাতি যখন চাকমা ভাষায় নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্রকে প্রদর্শনের ছাড়পত্র দেয় না, প্রগতিশীলেরা যখন ‘উসকানিমূলক’ লেখা প্রকাশ করতে নিষেধ করেন, তখন আসলে যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে বাংলাদেশ নামের একটি দেশের জন্মের কথা আমরা বলি, সেই ‘শোষণের নাগপাশ ছিন্ন করা’ যুদ্ধটা অপমানিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী শক্তি এই অন্যায় করলে যত না লাগে, মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছেন—রাজনৈতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক দুভাবেই—তাঁদের এই ব্যবহার লজ্জিত এবং ক্ষুব্ধ করে। হতবাকও করে, যখন দেখি, একুশে ফেব্রুয়ারির দিন হিন্দু পুরোহিতকে গলা কেটে মেরে ফেলা হয়; মাটিরাঙ্গায় নৃগোষ্ঠীর ওপর আক্রমণ করা হয়।
>অভিজিতের মৃত্যুবার্ষিকীতে যাঁরা শোকাহত, তাঁদের শোক বুঝি একান্তই ব্যক্তিগত। আমি জানি, বন্যা কীভাবে প্রতিটি মুহূর্তের মাশুল গুনছেন। কীভাবে দিন পার করছেন অজয় রায় স্যার আর তাঁর পরিবার, ধারণাও করতে পারি না। দুঃখ করছেন হাতে গোনা যে কয়েকজন, তাঁরাও আবার বিভক্ত
অথচ রাষ্ট্র কী নির্বিকার! প্রথমত, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের পাশাপাশি বুদ্ধিবৃত্তিক সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার প্রশ্নে যেমন নির্বিকার, অন্যদিকে, যেসব শক্তি এসব কাজ করে বেড়াচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের অবস্থানটি আজও জানা হলো না। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের পাশাপাশি দেশছাড়া হচ্ছেন তরুণ লেখক, ব্লগার, অ্যাকটিভিস্ট। যাঁরা হুমকিপ্রাপ্ত, অথচ দেশ ছাড়তে পারেননি, তাঁরা কীভাবে আতঙ্কে দিন কাটান, জানি না তাঁরা ছাড়া অন্য কেউ বোঝেন কি না। কিংবা তাঁরা যখন দেশের সীমানা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন, কেমন লাগে তাঁদের? সে সময়ের মনের অবস্থার বর্ণনা বুঝি পাওয়া যায় মিলান কুন্ডেরার বিখ্যাত বই দ্য বুক অব লাফটার অ্যান্ড ফরগিভিং-এ। লেখক বর্ণনা করেছেন সেই মুহূর্তের মানসিক অবস্থা, যখন সীমানা অতিক্রমকারী জানেন, সীমানা পার হলেই তাঁর নিজের মাতৃভাষা পরিণত হবে অর্থহীন কিছু ধ্বনিতে।
চার.
এই সমূহ ঘটনার সঙ্গে অভিজিৎ হত্যাবার্ষিকীর যোগ কোথায়? যোগ এখানেই যে অভিজিৎ যে কারণে খুন হয়েছেন, তাঁর খুনিরা যে কারণে এখনো অধরা, ঠিক সেই একই লেখার কারণে বা প্রকাশ করার কারণে খুন হয়েছেন অন্যরা। সেই একই বিবেচনায় তাঁদের খুনিরাও অধরা। পুলিশের কাছে নিরাপত্তা চাইতে গেলে পুলিশ দেশ ছেড়ে যাওয়ার উপদেশ দিচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। এই এক বছরে অভিজিৎ হত্যার কোনো সুরাহা হলো না। অথচ খুন হলেন অভিজিতের সঙ্গে সম্পর্কিত আরও কিছু মানুষ।
অভিজিতের মৃত্যুবার্ষিকীতে যাঁরা শোকাহত, তাঁদের শোক বুঝি একান্তই ব্যক্তিগত। আমি জানি, বন্যা কীভাবে প্রতিটি মুহূর্তের মাশুল গুনছেন। কীভাবে দিন পার করছেন অজয় রায় স্যার আর তাঁর পরিবার, ধারণাও করতে পারি না। দুঃখ করছেন হাতে গোনা যে কয়েকজন, তাঁরাও আবার বিভক্ত। মননশীল বইয়ের লেখকের নৃশংস মৃত্যুতে সরকারযন্ত্রের কিছুই যায়-আসে না। যাঁদের যায়-আসে, তাঁদের অনেকেই মারা গেছেন কিংবা দেশত্যাগ করেছেন। জীবনানন্দ দাশের প্রশ্ন ছিল, ‘শুকতারা নিভে গেলে, কাঁদে কি আকাশ?’ বন্ধু-সহযোদ্ধা ছাত্রনেতা রাজুর ডায়েরিতে এই পঙ্ক্তি দেখে আকুল হয়েছিলাম। আজ আর আকুল হই না। জানি যে আকাশ কাঁদেনি। কাঁদলে পরবর্তী হত্যাকাণ্ডগুলো হতো না। আমাদের প্রতিরোধের জোর ফেসবুকে যতখানি ছিল, রাজপথে ততখানি ছিল না। বইগুলো তবু রয়ে গেছে। শুনেছি, অক্ষর পোড়ে না, মরে না। ভাবতে ইচ্ছে করে, সেই অক্ষরগুলো ফিনিক্স পাখি হয়ে সব ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে উড়ে আসবে। যুক্তির আলো জ্বালাবে আরও অনেকের মনে।
আর আমার কাজ বুঝি সেই সিন্দবাদের নাবিকের মতো। কে এই কাজ দিয়েছে জানি না, অমোঘ নিয়তির মতো এসব হত্যাকাণ্ডের দিনলিপি লিখে চলেছি ক্রমাগত—অভিজিৎ, ওয়াশিকুর, অনন্ত, নিলয়, দীপন...অথচ আজও ফেব্রুয়ারি, আজও রমনায় ঊর্ধ্বমুখী কৃষ্ণচূড়ার বিস্তার।
কাবেরী গায়েন: অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।