হংকংয়ে গণতন্ত্র এলে চীনেরই লাভ
হংকংয়ের চলমান আন্দোলন দমনে চীন তেমন কোনো কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এটি থেকে হংকং ইস্যুতে চীনের কঠোর অবস্থান থেকে সরে আসার নীতি অনুসরণের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। মনে হচ্ছে চীন একধরনের ধৈর্যশীলতা প্রদর্শনে মনোযোগী হয়েছে। এ প্রসঙ্গে পর্যালোচনা করতে গিয়ে ৭০ বছর ধরে তাইওয়ান ইস্যুতে চীন কী নীতি নিয়ে এগোচ্ছে, তা আবার উঠে আসছে।
বেইজিং ও তাইপের বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, হংকংকে পূর্ণ গণতন্ত্রের পথে হাঁটতে দেওয়ার বিষয়ে চীনের আত্মবিশ্বাসী অবস্থানে থাকাই চলমান সংকট সমাধানের সবচেয়ে সহজ পথ। এতে বিক্ষোভের পালে হাওয়া লাগা বন্ধ হবে, সহিংসতার আগুন নিভে যাবে এবং চীনের জন্য যেসব হুমকি দেখা দিচ্ছে, তার অবসান হবে।
এটি কেউ অস্বীকার করবে না যে হংকং এবং তাইওয়ান আজ যে উন্নত অর্থনৈতিক অবস্থানে আসতে পেরেছে, তার পেছনে উচ্চশিক্ষিত চীনা নাগরিকেরা প্রধান ভূমিকা রেখেছেন। উদ্ভূত হংকং পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অবধারিতভাবে তাইওয়ানের দিকে ফিরে তাকাতে হচ্ছে।
তাইওয়ান একসময় চীনের কুক্ষিগত ছিল। এখন সে অবস্থা থেকে তারা বেরিয়ে এসেছে। চীনের প্রভাব যথেষ্ট জোরালো থাকলেও সেখানে এখন গণতন্ত্র আছে। তবে হংকংয়ে তা নেই। হংকংয়ের সার্বভৌমত্ব পুরোপুরি চীনের কবজায়। যদিও ‘এক দেশ, দুই নীতি’খ্যাত একটি চুক্তি অনুযায়ী, ২০৪৭ সাল পর্যন্ত হংকংয়ের জনসাধারণ ‘স্বাধীনভাবে ও পুঁজিবাদী ধারায়’ জীবন যাপন করতে পারবে বলে বলা হয়েছে।
হংকংয়ে প্রথম বড় ধরনের বিক্ষোভ হয় ২০১৪ সালে। জনগণের সরাসরি ভোটে এই ভূখণ্ডের প্রধান নির্বাহী নির্বাচিত হবেন—এমন ব্যবস্থা অস্বীকার করায় সে বছর জনগণ বিক্ষোভ শুরু করে। সে বছর নির্বাচন ছাড়াই বেইজিংয়ের মনোনীত প্রতিনিধিকে প্রধান নির্বাহী করা হয়।
এবারের বিক্ষোভের সূত্রপাত হয়েছে একটি আইনকে ঘিরে। চীন চাইলে হংকংয়ের যে কাউকে বেইজিংয়ের হাতে হস্তান্তর করতে হবে—এমন আইন করার পরই বিক্ষোভ শুরু হয়। পরে এই ইস্যুর সঙ্গে আরও কিছু বিষয় যোগ হয়। যেমন পুলিশের নির্যাতন, যেকোনো বিষয়ে বেইজিংয়ের হস্তক্ষেপ, জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ক্ষুণ্ন করা, ইত্যাদি। বেইজিংয়ের কাছে হংকংবাসীকে তুলে দেওয়াসংক্রান্ত আইন ইতিমধ্যেই তুলে নেওয়া হয়েছে। তারপরও রাজপথের বিক্ষোভ থামেনি।
ইতিমধ্যে এক দিনেই হংকংয়ের বিক্ষোভে ২০ লাখ মানুষকে রাস্তায় জড়ো হতে দেখা গেছে। একটি ভূখণ্ডের এক–চতুর্থাংশ লোক যখন রাস্তায় নেমে আসে, তখন যেকোনো শাসক, পরিচালক বা নির্বাহীকে বুঝতে হবে, তাঁরা গুরুতর সমস্যায় আছেন।
এ অবস্থায় ঠিক কোন পদক্ষেপ নিলে সব সংকটের অবসান ঘটবে, তা নির্ণয় করা খুবই কঠিন। বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, পরিস্থিতি শান্ত করতে বেইজিংকে অনেক উদার হয়ে বড় ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে। সবচেয়ে সহজ ও সঠিক পথ হবে, হংকংকে পূর্ণাঙ্গ গণতান্ত্রিক স্বায়ত্তশাসন দেওয়া এবং তাইওয়ানের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, এতে জনক্ষোভ যা ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে, তা থেকে বেইজিং রেহাই পাবে।
তাইওয়ান চীনের মূল ভূখণ্ড থেকে বেশ দূরে অবস্থিত। দেশটি কার্যত স্বাধীন এবং চীনের চালানো সামরিক অভিযান তাৎক্ষণিকভাবে ঠেকিয়ে দেওয়ার জন্য দেশটির একটি সেনাবাহিনীও আছে। হংকংয়ের মতো তাইওয়ানের অর্থনীতিও চীনের ওপর নির্ভরশীল। চীনের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্কের কারণেই এই দুই ভূখণ্ডের মানুষ উন্নত জীবন যাপন করতে পারে। কূটাভাস হলো এই, চীন একই সঙ্গে তাইওয়ানের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক পার্টনার এবং সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা হুমকি। তাইওয়ানের ভোটাররা বরাবরই পরিষ্কার বার্তা দিয়ে এসেছেন যে তাঁরা চীনের সঙ্গে নিরাপদ দূরত্ব রাখতে চান। তাঁরা খুব ঘনিষ্ঠও হতে চান না, খুব দূরত্বও চান না। এতে দুই পক্ষই লাভবান হয়েছে।
ঠিক একই মডেলে হংকংয়ের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক হতে পারে। তাইওয়ানের মতো হংকংয়ে বহু পশ্চিমা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস আছে। সেখানে চীনের তরুণ প্রজন্ম লেখাপড়া করেন এবং সেই শিক্ষিত তরুণেরা চীনের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখেন। হংকংয়ের প্রধান নির্বাহী যদি সাধারণ ভোটারদের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হন এবং এ ক্ষেত্রে যদি চীন হস্তক্ষেপ না করে, তাহলে ভূখণ্ডটির মানুষ গণতন্ত্রের স্বাদ পাবে। এতে চীনেরও বড় ধরনের কোনো ক্ষতি হবে না, বরং হংকংয়ে চীনবিরোধী প্রোপাগান্ডা বন্ধ হবে।
খালিজ টাইমস থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত
হামফ্রে হক্সলি: ব্রিটিশ রাজনৈতিক পর্যালোচক