হংকং বিক্ষোভ: বিল বাতিলের নেপথ্যে

বন্দী প্রত্যর্পণ বিল প্রত্যাহারের দাবিতেই উত্তাল হংকং। ছবি: এএফপি
বন্দী প্রত্যর্পণ বিল প্রত্যাহারের দাবিতেই উত্তাল হংকং। ছবি: এএফপি

অপ্রত্যাশিতভাবে বন্দী প্রত্যর্পণ বিল বাতিল করলেন হংকংয়ের প্রধান নির্বাহী ক্যারি লাম। এই বিল প্রত্যাহারের দাবিতেই কয়েক মাস ধরে উত্তাল ছিল হংকং। প্রস্তাবিত এই বিলে হংকংয়ের সন্দেহভাজন অপরাধীদের মূল ভূখণ্ড চীনের কাছে হস্তান্তর করার কথা বলা হয়েছে। এর আগে হংকংবাসীর তীব্র আন্দোলনের মুখে গত ১৫ জুন ক্যারি ল্যাম বন্দী প্রত্যর্পণ বিল স্থগিত করেছিলেন। কিন্তু ততে শান্ত হয়নি জনগণ। তারা বিলটি প্রত্যাহারের দাবিতে বিক্ষোভ অব্যাহত রাখে। এ সময় গ্রেপ্তার হয়েছে এক হাজারের বেশি মানুষ। 

ক্যারি লাম প্রথমে বিলটি প্রত্যাহারে দৃঢ়ভাবে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন, এমনকি আইনসভার বাইরে প্রায় ১০ লাখ মানুষের সহিংস বিক্ষোভেও তিনি তাঁর সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন। আইনসভার সদস্যরা যাতে বিলটি পাসের জন্য বৈঠক করতে না পারেন, সে জন্য জনগণ তাঁদের শারীরিককভাবে বাধাও দিয়েছিল। তবু ক্যারি লামের মন গলেনি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কেন হঠাৎ তিনি বিলটি বাতিল করলেন? এটা কি চীন সরকারের সঙ্গে বোঝাপড়ার একটি অংশ? 

হংকংবাসীর দাবি পূরণে লামের অস্বীকৃতির বিষয়টি একটা সময় ব্যাখ্যার অতীত বলে মনে হয়েছে। এই দাবি শুধু সাধারণ জনগণের নয়, সমাজের অনেক ক্ষেত্রের মানুষ; যেমন শিক্ষাবিদ, আইনজীবী ও চিকিৎসকদেরও দাবি। উত্তেজনা কমাতে সরকারের পক্ষে সবচেয়ে সহজ পদক্ষেপ ছিল বিলটি বাতিল করা। গত ১৩ আগস্ট একটি সংবাদ সম্মেলনে ক্যারি লামকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে চীন সরকার তাঁর হাত বেঁধে রেখেছে কি না, যার কারণে বিলটি প্রত্যাহারের ব্যাপারে তিনি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। কিন্তু ক্যারি লাম সেই প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যান। 

গত জুন মাসে বিলটি স্থগিত করার আগে ক্যারি লাম চীনের উপপ্রধানমন্ত্রী হান ঝেংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন। একটি বিশ্বস্ত সূত্র অনুযায়ী, ওই বৈঠকে লাম ওই চীনা কর্মকর্তাকে জানিয়েছিলেন যে তিনি বিলটি কেবল স্থগিত করবেন, প্রত্যাহার করবেন না। এই কারণেই তিনি তখন থেকেই অনুভব করেছিলেন যে তিনি নিজেই নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করবেন না। বুধবারের বিল প্রত্যাহারের ঘোষণাটি আসে হংকংয়ের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে লামের রুদ্ধদ্বার বৈঠকের একটি অডিও প্রকাশ হওয়ার দুদিন পর। গত সপ্তাহে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে হংকংয়ের বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য ক্যারি লাম নিজেকে দায়ী করেন। তিনি বলেছেন, রাজনৈতিক সংকটের সূচনা করে ‘ক্ষমার অযোগ্য বিপর্যয়’ ডেকে এনেছেন এবং সুযোগ থাকলে পদত্যাগ করতেন। বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তাঁর হাতে ক্ষমতা খুব অল্প বলেও জানান তিনি। তিনি আরও বলেছেন, বিশ্বের দুটি বৃহত্তম অর্থনীতির (যুক্তরাষ্ট্র-চীন) মধ্যে নজিরবিহীন উত্তেজনার মধ্যে হংকংয়ের বিক্ষোভ আক্ষরিক অর্থেই একটি বিপর্যয়। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম রয়টার্স ওই অডিও ফাঁস করে। রয়টার্স এর আগে জানিয়েছিল, চলতি গ্রীষ্মের শুরুতে তিনি বিলটি প্রত্যাহার করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তখন বেইজিং তাঁকে তা করতে নিষেধ করে। 

অর্থনৈতিক উত্তেজনার বিষয়ে মিসেস লামের উল্লেখটি স্পষ্ট করে দেয় যে হংকং এখন যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্যযুদ্ধের একটি বড় অংশ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এখন হংকং এবং বাণিজ্যযুদ্ধকে স্পষ্টভাবে সংযুক্ত করছেন, যদিও চীন এই সংযুক্তির বিষয়টি অস্বীকার করছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প অবশ্য বলেছিলেন, হংকংয়ের বিক্ষোভ একটি অভ্যন্তরীণ বিষয়। হংকংবাসীর বিক্ষোভ গুরুত্বপূর্ণ এই অর্থনৈতিক কেন্দ্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এই বিক্ষোভ বেশির ভাগ সময় শান্তিপূর্ণ ছিল। তবে মাঝেমধ্যেই তা সহিংস হয়েছে। বিক্ষোভকারীদের প্রধান দাবি ছিল প্রস্তাবিত বিলটি প্রত্যাহার করা, তবে পুলিশের ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগের তদন্ত করার জন্য স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনসহ আরও বেশ কিছু দাবি ছিল। এর মধ্যে ক্যারি লাম স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনের ব্যাপারে আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, স্বাধীন কমিশন নয়, তবে এ রকমই কিছু একটা গঠন করা হবে। 

বিক্ষোভকারীদের অন্যান্য দাবি, যেমন বিক্ষোভকে রায়ট হিসেবে বর্ণনা করা ও সর্বজনীন ভোটাধিকারসহ অনেক দাবির সমাধান এখনো হয়নি। বিক্ষোভকারীরা এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, সব দাবিই পূরণ করতে হবে। তা না হলে বিক্ষোভ অব্যাহত থাকবে। দেরিতে হলেও শেষ পর্যন্ত সরকার যে হংকংবাসীর দাবির প্রতি সাড়া দিয়েছে, সেটাই বড় কথা। আমি বলতে চাই, বাকি দাবিগুলো যদি যৌক্তিক হয়, তবে সরকারের উচিত তা পূরণ করা। এখানে দেরি না করাই ভালো হবে। 

দ্য গ্লোব অ্যান্ড মেইল থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত


ফ্রাঙ্ক চিং হংকংয়ের সাংবাদিক