সাদা থান শাড়িতে পাঁচ নারী, সঙ্গে সাদা ধুতিতে মাথা কামানো তিন শিশু, পাশে ঘিয়ে রঙের শাড়িতে আরেক নারী। শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের একটি ছবি। ১২ ফেব্রুয়ারি দেশের প্রায় সব জাতীয় দৈনিকের প্রথম পাতায় ছবিটা ছাপা হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও তা ছড়িয়ে পড়ে। কোনো কান্না, বিলাপ কিংবা আহাজারি নেই; স্তব্ধ, স্থিতধী ছবিটা যেন রবীন্দ্রনাথের অসীম সাদাকালোর চূড়ান্ত প্রকাশ। তবে সেখানে রং নেই, রূপ নেই; আছে নিঃসীম হাহাকার আর শূন্যতা আর জীবনের অনিশ্চয়তা।
মহাভারতের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ মানুষের ট্র্যাজিক পরিণতির ধ্রুপদি দৃষ্টান্ত। যুদ্ধের উত্তেজনা ও জয়-পরাজয়ের মীমাংসা একসময় শেষ হয়। যুদ্ধে যাঁরা প্রাণ হারিয়েছেন, তাঁরা তো এক অর্থে বেঁচেই গেছেন। কিন্তু যুদ্ধ যেখানে শেষ হচ্ছে, সেখানেই নারীদের জীবনে মহাকাব্যিক ট্র্যাজেডি শুরু হয়। এক গান্ধারীই হারান তাঁর শত পুত্র। অন্য নারীরাও তাঁদের স্বামী ও সন্তানদের হারিয়েছেন। তাঁদের কান্না, শোক, বিলাপ, নিস্তব্ধতা, দীর্ঘশ্বাস তো বাকি জীবনভর। মহাভারতের স্ত্রী পর্বে সেই ভয়াবহ জীবন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় গঙ্গাতীরে স্বামীহারা-সন্তানহারা নারীদের আহাজারিতে।
কুরুক্ষেত্রের এই মহা ট্র্যাজেডির সঙ্গে বাংলাদেশের সড়কে মৃত্যুর যে মিছিল, তার তুলনা দূরবর্তী হবে না। নারী ও শিশুমৃত্যুকে বিবেচনায় নিলে বরং সেটা ছাপিয়ে যাবে। একেকটা দুর্ঘটনা (কাঠামোগত হত্যা) একেকটা পরিবারকে মুহূর্তেই ছবিতে পরিণত করছে। যে শিশু, যে নারী জীবিত থাকছেন, তাঁরা কীভাবে বেঁচে থাকছেন, আমরা কি ভাবতে পারছি? গত ৮ ডিসেম্বর মানু রানী, তাঁর পাঁচ পুত্রবধূ ও তিন শিশুসন্তানের জীবনে নেমে আসে অমোঘ ট্র্যাজেডি। মানু রানীর স্বামী সুরেশের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল ৩০ জানুয়ারি। বাবার শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের জন্য তাঁদের ৯ সন্তান এসেছিলেন চকরিয়ার কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার ডুলাহাজারা ইউনিয়নের হাসিনাপাড়ায়। গত ৮ জানুয়ারি একটি মন্দিরে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান শেষে একসঙ্গে ৯ ভাইবোন (৭ ভাই ও ২ বোন) পায়ে হেঁটে বাড়িতে আসার জন্য সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। বেপরোয়া গতির একটা পিকআপ ভ্যান তাঁদের পিষে দেয়। মারা যান পাঁচ ভাই। আরেক ভাই লাইফ সাপোর্টে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। বাবার শ্রাদ্ধানুষ্ঠান পরিণত হয় সন্তানদেরও শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে। মানু রানী, তাঁর পাঁচ পুত্রবধূ ও তাঁদের তিন শিশুর সেই ছবিটাই গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়।
কুরুক্ষেত্রের এই মহা ট্র্যাজেডির সঙ্গে বাংলাদেশের সড়কে মৃত্যুর যে মিছিল, তার তুলনা দূরবর্তী হবে না। নারী ও শিশুমৃত্যুকে বিবেচনায় নিলে বরং সেটা ছাপিয়ে যাবে। একেকটা দুর্ঘটনা (কাঠামোগত হত্যা) একেকটা পরিবারকে মুহূর্তেই ছবিতে পরিণত করছে। যে শিশু, যে নারী জীবিত থাকছেন, তাঁরা কীভাবে বেঁচে থাকছেন, আমরা কি ভাবতে পারছি? গত ৮ ডিসেম্বর মানু রানী, তাঁর পাঁচ পুত্রবধূ ও তিন শিশুসন্তানের জীবনে নেমে আসে অমোঘ ট্র্যাজেডি।
গত ১৭ জানুয়ারি প্রথম আলোতে প্রকাশিত একটি সংবাদের শিরোনাম, ‘দুর্ঘটনায় নিহত মা, সন্তানটি বারবার জানতে চাচ্ছিল মা কখন আসবে’। কাপড় বানানোর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে গিয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো মোছা. শান্তার (২২) তিন বছর বয়সী ছেলে আল সাইম বাড়ির সবাইকে প্রশ্ন করছিল, মা কখন আসবে? এ কথা শুনে গতকাল রোববার গাজীপুরের কাপাসিয়ার সনমানিয়া গ্রামের ব্যাপারীপাড়া এলাকায় শান্তার বাড়িতে আসা সবার চোখ আর্দ্র হয়ে যায়। একই সড়ক দুর্ঘটনায় শান্তার ননদ নাজমা বেগম নিহত হন। আহত হন ভাই সোহেল রানা। তাঁরা তিনজন একই মোটরসাইকেলের আরোহী ছিলেন। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাঁচদোনা এলাকায় তেলবাহী একটি লরি তাঁদের মোটরসাইকেলকে পেছন থেকে ধাক্কা দেয়।
বাংলাদেশে সড়কে দুর্ঘটনা ও হতাহতের যে পরিসংখ্যান, তা যে কারও মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ থেকে ২০২০—এই ছয় বছরে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৩ হাজার ৮৫৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত ও পঙ্গু হয়েছেন ৯১ হাজার ৩৫৮ জন। এ সময়ে মোট দুর্ঘটনার সংখ্যা ৩১ হাজার ৭৯৩টি। ২০২১ সালে দেশে ৫ হাজার ৬২৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৭ হাজার ৮০৯ জন। আহত হয়েছেন ৯ হাজার ৩৯ জন। সড়ক, রেল ও নৌপথে মোট দুর্ঘটনার ৯১ শতাংশই সড়কে ঘটছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, সারা দেশে প্রতিদিন গড়ে ৬৪ জন মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছেন, আর আহত হচ্ছেন ১৫০ জনের বেশি।
সড়কে মৃত্যুর মিছিল বাংলাদেশের মানুষের কাছে যেন স্বাভাবিক একটা বিষয়ে পরিণত হয়েছে। কিন্তু যে পরিবারের প্রিয় মানুষ নিমেষেই ‘আছে থেকে নাই’ হয়ে যাচ্ছেন, সেই পরিবারটাই বুঝতে পারছে প্রিয়জন হারানোর যন্ত্রণা। পরিবারের সেই সদস্যটা যদি একমাত্র উপার্জনক্ষম হন, তাহলে সেই অভিঘাতটা কতটা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে? মানু রানী, তাঁর পাঁচ পুত্রবধূ ও তিন শিশুসন্তানের জীবনে যে অনিশ্চয়তা ও অভিঘাত তৈরি হলো, সেটা কি আমাদের স্পর্শ করতে পারছে? সরকার, নীতিনির্ধারক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, পরিবহনমালিক-চালক-শ্রমিক কিংবা সমাজের কোনো অংশের কাউকে? আমরা যেন এক নিয়তিনির্ধারিত সড়কের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছি, যেখানে স্বজনের মৃত্যুটাই অনিবার্য। দুর্ঘটনায় যাঁরা মারা যাচ্ছেন, তাঁরা নাহয় পরিসংখ্যান হয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু স্বামী হারিয়ে যে নারীটা বিধবা হচ্ছেন, যে মা তাঁর সন্তানদের হারাচ্ছেন, যে শিশুটি তাঁর চরম আশ্রয় মা-বাবাকে হারাচ্ছেন, তাঁদের অসহায়তা কি আমাদের স্পর্শ করতে পারছে?
স্পর্শ করলে তো এই অনাকাঙ্ক্ষিত কিংবা কাঠামোগত হত্যাকে অনেকটাই ঠেকানো সম্ভব হতো। যে পিকআপটি মানু রানীর সন্তানদের রাস্তার সঙ্গে পিষে দিয়েছে, সেই চালকের সেটি চালানোর বৈধ কোনো কাগজ ছিল না। বেপরোয়া গতিতে পিকআপটি চালিয়ে আসছিলেন তিনি। বৈধ কাগজপত্র ছাড়া সেই পিকআপ ভ্যানটি কী করে রাস্তায় চলল? কিংবা পিকআপের মালিক কী করে এমন একজন ব্যক্তির হাতে তাঁর যান্ত্রিক যানটির স্টিয়ারিংটি ধরিয়ে দিলেন? আমরা সবাই এর কারণগুলো জানি, সমাধানগুলোও জানি। কিন্তু উন্নয়ন, উন্নতি আর নগদ পাওনার এমন এক কুরুক্ষেত্রের মধ্যে আমাদের সবাইকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে, যেখানে কারও জীবনের নিরাপত্তা নেই। এ চক্রে যেকোনো মুহূর্তেই আপনি, আমি জীবন্ত মানুষ থেকে ছবিতে পরিণত হতে পারি।
সড়ক দুর্ঘটনায় যে পরিবারটি তাদের স্বজন হারাচ্ছে, তাদের অসহায়তা আরও বহুগুণ বেড়ে যায়। কেননা রাষ্ট্র, সমাজ কেউই তাদের পাশে এসে দাঁড়ায় না। সমাজের একটা অংশের উন্নয়ন-উন্নতির স্বার্থে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো নাহয় হবে না, তাই বলে হতাহত পরিবারগুলোর পাশে রাষ্ট্র ও সরকার কি দাঁড়াতেও পারবে না? মানু রানীর পরিবারে যে বিপর্যয়, স্মরণকালে একটা পরিবারের ক্ষেত্রে এত বড় বিপর্যয়ের ঘটনা খুব কমই ঘটেছে। কোনো জনপ্রতিনিধি কিংবা প্রজাতন্ত্রের কোনো প্রতিনিধি কি তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। তিন বছরের শিশু সাইম যে মাকে খুঁজে ফিরছে, ওর পাশে কে দাঁড়াবে? আমাদের রাষ্ট্র, উন্নয়নে মানুষই যদি বাদ পড়ে যায়, তাহলে আর বাকি কী থাকল?
মনোজ দে প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক