সড়কে প্রতিদিন 'খুন': মন্ত্রীদের দায় নেই?
দিয়া খানম ওরফে মিম ও আবদুল করিম কি কখনো ভাবতে পেরেছিল, তারা কলেজে গিয়ে আর কখনো ফিরে আসবে না? ঘরে ফেরার আগেই ঘাতক বাসচালক তাদের খুন করে পালিয়ে যাবেন?
রোববারের দুর্ঘটনাটির কারণও দুই বাসের অসুস্থ প্রতিযোগিতা। এটিকে নিছক দুর্ঘটনা বলে চালানোর সুযোগ নেই। পরিকল্পিত না হলেও কার্যকারণঘটিত হত্যাকাণ্ড। আমরা এ রকম কার্যকারণঘটিত হত্যা দেখতে দেখেতে ক্লান্ত। আর কত এই হত্যা আমাদের দেখতে হবে?
প্রতিদিনই সড়ক ঘটনায় মানুষ মারা যাচ্ছে। আমাদের চোখ সওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু রোববার রাতে টিভিতে মিম ও করিমের ছবি দেখে সত্যি মনটা খারাপ হয়ে গেল। দুজন কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থী, যাদের নিয়ে বাবা-মায়ের এত প্রত্যাশা, তাদের কিনা জীবন দিতে হলো দুই বাসের রেষারেষিতে পড়ে। দুটি পরিবারের শান্তি ও স্বপ্ন চূর্ণ হয়ে গেল।
মিম ও করিমের বাবা-মায়ের কাছে কী কৈফিয়ত দেব আমরা?
কেন আমরা তাদের নিরাপত্তা দিতে পারি না?
কেন এভাবে পথ চলতে মানুষ মারা যাবে?
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তিদের ভাষ্য অনুযায়ী, ঘটনার সময় ওই কলেজের শিক্ষার্থীরা র্যাডিসন ব্লু হোটেলের পাশ দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছিল। অনেকে বাসের জন্য ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ছিল। এ সময় জাবালে নূর পরিবহনের একটি বাস এলে শিক্ষার্থীরা তাতে ওঠার চেষ্টা করে। একই সময়ে জাবালে নূর পরিবহনের আরেকটি বাস বাঁ পাশ দিয়ে ঢুকে দুই শিক্ষার্থীদের চাপা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যায় শহীদ রমিজউদ্দীন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষার্থী মিম ও করিম। খবর পেয়ে প্রতিষ্ঠানের অন্য শিক্ষার্থীরা এসে সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে এবং কয়েকটি যানবাহন ভাঙচুর করে।
একই পরিবহনের দুটি বাস একই সময়ে একই জায়গায় আসার কথা নয়। নির্দিষ্ট বিরতিতে নির্দিষ্ট স্থানে আসার কথা। কিন্তু কেন দুটি বাস একই স্থানে রেষারেষিতে নামল? কারণ, বাসমালিকেরা কর্মীদের দৈনিক আয়ের সীমা বেঁধে দেন। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে না পারলে মজুরি বন্ধ। ফলে, ঢাকা শহর এবং সারা দেশে যাত্রীবাহী বাসগুলোর মধ্যে নিয়ত চলে অসুস্থ প্রতিযোগিতা। সেই বাস হোক একই কোম্পানি বা আলাদা আলাদা কোম্পানির। এমনকি বিআরটিসির বাসও এই প্রতিযোগিতার বাইরে নয়। বিআরটিসির বাসগুলো এখন বেসরকারিভাবে ইজারা দিয়ে চালানো হয়। বাস যত বেশি ট্রিপ দিতে পারবে, ইজারাদারের আয় তত বেশি হবে। চালক অসুস্থ হোক, যাত্রী মারা যাক, সেটি দেখার বিষয় নয়।
এই অসুস্থ প্রতিযোগিতার কারণে কোনো বাসচালকই আইনকানুনের তোয়াক্কা করেন না। যেখানে খুশি বাস থামান। সড়কের মাঝখানে যাত্রী নামিয়ে দেন। আবার মাঝখান থেকেই যাত্রী তুলে নেন। সড়ক পরিবহন দেখভালের দায়িত্ব যাঁদের, তাঁরা এসব দেখেন না। ট্রাফিক পুলিশ আমলে নেন না। ফলে সড়কে দুর্ঘটনা ঘটছে, মানুষ মারা যাচ্ছে।
সড়ক দুর্ঘটনার জন্য যাঁরা দায়ী, সরকারের নীতিনির্ধারকদের দেখি, তাদের পক্ষেই কথা বলছেন। নিরীহ যাত্রীদের পক্ষে কেউ নেই। তাঁরা বেঘোরে মারা যাবেন, আর মন্ত্রীরা যাত্রীদের সচেতন হওয়ার সবক দেবেন, এটি অসহনীয়। যাত্রীদের অবশ্যই সচেতন হতে হবে। কিন্তু বাসের চালক-সহকারীরা যদি অসুস্থ প্রতিযোগিতায় মত্ত থাকনে, তাহলে যাত্রীদের সচেতনতা যে কোনো কাজে আসে না, রোববারের ঘটনাই তার প্রমাণ। সেখানে কোনো যাত্রী গাড়িতে বসে বাইরে হাত রাখেননি। কেউ দৌড়ে বাসে ওঠারও চেষ্টা করেনি। তারা সারিবদ্ধ হয়ে বাসে উঠছিল। কেউ সড়কের পাশে দাঁড়িয়েছিল। আর তখনই পেছন থেকে আরেকটি বাস এসে অপেক্ষমাণ যাত্রীদের ওপর চড়াও হয়।
এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা সম্পর্কে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য না করলেও নৌপরিবহনমন্ত্রী শাহজাহান খান যা বলেছেন, তা গিনেস বুকে নাম লেখানোর মতো স্মরণীয় হয়ে থাকবে। মানুষের মৃত্যু নিয়ে এত নিষ্ঠুর মন্তব্য কেউ করতে পারে না। শাহজাহান খান নিজের মন্ত্রণালয় নিয়ে কিছু বলেন না। কথা বলেন সড়ক নিয়ে। কেননা, তিনি একই সঙ্গে সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি। একই ব্যক্তি মন্ত্রী, মালিকপক্ষ ও শ্রমিকনেতা। সড়ক পরিবহন শ্রমিক ও মালিকেরা যত অন্যায়ই করুন না কেন, তিনি চরম উদাস। কিন্তু এ নিয়ে কেউ প্রশ্ন করলেই মন্ত্রী ক্ষুব্ধ হন। রোববার সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসার জবাবে তিনি বলেছেন, ভারতের মহারাষ্ট্রে সড়ক দুর্ঘটনায় ৩২ জন মানুষ মারা গেলেও নাকি কেউ প্রশ্ন করেননি। মন্ত্রী মহোদয়কে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে ভারতে চালকের কোনো সহযোগী বাস চালাতে পারেন না কিংবা গরু–ছাগল চিনলেই কেউ বাস চালানোর লাইসেন্স পায় না। তাঁর মতো মন্ত্রীদের কল্যাণে বাংলাদেশে পায়। তিনি বলেছেন, যে যেটুকু অপরাধ করেছে, সে ততটুকুর বিচার পাবে। তাঁর এ কথার মাজেজা কী। কেউ কি আইনের বাইরে গিয়ে চালকদের বিচার করতে বলেছেন? বলেননি। আইনানুযায়ী বিচারই চেয়েছেন সবাই।
নৌপরিবহনমন্ত্রী যখন বাসচালকের পক্ষে সাফাই গাইছেন, তখন শোনা যাক একজন চালক কী বলেন। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত দিয়া খানম মিমের বাবা জাহাঙ্গীর আলমও একজন বাসচালক। তিনি ৩০ বছর ধরে ঢাকা-রাজশাহী সড়কে বাস চালান। তিনি অভিযোগ করেছেন, যাকে–তাকে স্টিয়ারিংয়ে বসানোর কারণেই এত দুর্ঘটনা ঘটছে। অনেক পরিবহন মালিক কম মজুরিতে অপ্রশিক্ষিত ও অদক্ষ চালক দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছেন বলেই দুর্ঘটনা ঘটছে। মানুষ মারা যাচ্ছে।
ঘরে–বাইরে কোথাও বাংলাদেশের মানুষ নিরাপদ নয়। ঘর থেকে বেরিয়ে জুমার নামাজ পড়তে গিয়ে তিতাস উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা পারভেজ সরকার অপহৃত হলেন। আট ঘন্টা পর তিনি ঘরে ফিরে এলেও আগে অপহৃত হওয়া অনেকেই ফিরে আসেননি। আর সড়ক নামলেই দেখা যায় মৃত্যু ওত পেতে আছে। ১ জুলাই বসুমতী পরিবহনের একটি বাসের চাপায় নিহত হন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী শাহরিয়ার সৌরভ, ২ জুলাই মিরপুরে দিশারী পরিবহনের বাসের চাপায় মারা যান সৈয়দ আদনান মাসুদ রানা নামের আরেক শিক্ষার্থী। গত ১৬ এপ্রিল দুই বাসের রেষারেষিতে তিতুমীর কলেজের ছাত্র রাজীব হাত হারান, পরে তিনি মারা যান।
এভাবেই সড়কে মৃত্যুর মিছিল চলছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ নীরব। এই নীরবতা কবে ভাঙবে?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan 55 @gmail.com